ইউনুস মিয়া (চট্টগ্রাম প্রতিনিধি) বিশেষ প্রতিবেদনঃ আজ (শনিবার) “আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস” ২০২০। এ উপলক্ষে হালদা নদীর ডলফিন রক্ষার উদ্যোগে হালদা নদীর পাড়ে চট্টগ্রাম বন বিভাগ (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) কর্তৃক হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারাস্থ ড. শহীদুল্লাহ একাডেমীতে সচেতনতামূলক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, বিশেষ অতিথি থাকবেন হালদা বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া।
ইতিমধ্যে হালদা নদীর জীব বৈচিত্র, কার্প জাতীয় মা মাছ ও ডলফিন রক্ষায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিয়েছে হাই কোর্ট।
কমিটির নাম হবে ‘হালদা নদীর ডলফিন হত্যা রোধ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীব বৈচিত্র এবং সকল প্রকার মা মাছ রক্ষা কমিটি’।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের দেওয়া প্রতিবেদন দেখার পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে সম্প্রতি এ আদেশ জারি করা হয়।
হালদা তীরের এলাকার সংসদ সদস্যরা কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন। তাঁদের উপদেশ অনুযায়ী এ কমিটিকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়েছে আদেশে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে সভাপতি এবং চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার; নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড,পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিনিধি; জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ছাড়াও হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, রাউজান, রামগড় ও মানিকছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসকের মনোনীত দুইজন হালদা গবেষক, দুইজন এনজিও প্রতিনিধি এবং নদী তীরবর্তী উপজেলা চেয়ারম্যানদের কমিটিতে রাখতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই কমিটিকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে আদেশে।
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে ক্রমাগত ডলফিন নিধনের কারনে জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
যেকোন মুল্যে ডলফিন নিধন রুখতে না পারলে হালদা তার ‘নিজস্বতা’ হারাবে। এতে শুধু চট্টগ্রাম নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র দেশ।
হালদার দেখভালের দায়িত্বে থাকা হাটহাজারি উপজেলা প্রশাসনের সূত্র মতে, ১৪ অক্টোবর হালদা নদীর রাউজান আজিমের ঘাট এলাকা থেকে
২৭তম মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। ডলফিনটির দেহের মাঝ বরাবর এবং লেজের অংশে কাটা ও আঘাতের চিহ্ন ছিল।এটির দেহের দৈর্ঘ্য ৪৬ ইঞ্চি, ওজন প্রায় ৩০ কেজি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, আজিমের ঘাট এলাকায় গেল ২১ মার্চ একটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। ৮ মে উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ারচর থেকে কাটা অবস্থাায় উদ্ধার করা হয় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ডলফিন।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এক জরিপ মতে, বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে যেখানে অতি বিপন্ন প্রজাতির এক হাজার ডলফিন রয়েছে । তার মধ্যে হালদা নদীতে ডলফিন ছিল ১৭০টি। ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ২৭টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এভাবে ডলফিন হত্যার কারনে শুধু ডলফিনের সংখ্যাই কমছে না, বরঞ্চ হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্রও।
বিশেষজ্ঞদের মতে ১৪ অক্টোবর উদ্ধারকৃত ডলফিনটিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উদ্ধারের তিন দিন আগেই এটি মারা যেতে পারে। পরে উদ্ধারকৃত ডলফিনটি রাতেই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি চাপা দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, প্রায় সময় হালদা নদীতে মৃত ডলফিন ভেসে ওঠার ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি চরম অশনি সংকেত।
উদ্ধারকৃত প্রায় প্রতিটি ডলফিনের শরীরেথাকে আঘাতে দাগ। এতেই প্রতিয়মান হয় যে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। ডলফিন নিধনের প্রতিকারের কথা জানাতে গিয়ে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ১৩৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে গত দুই বছরে। গভীর রাতেও অভিযান চালিয়েছি। এসব অভিযানে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ৯টি ড্রেজার ও ২৭টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা, কারাদ- দেওয়া হয় ৩ জনকে। তবুও লোভাতুর কিছু অসাধু মানুষের শকুনি দৃষ্টি থামছেই না। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্রের আধার ডলফিনকে হত্যা করা হচ্ছে। ডলফিন হত্যাকারীদের শুভ বুদ্ধিও উদয় হলে এদেশ বাচেঁ। বাচেঁ জীববৈচিত্রও। রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবির সোহাগ জানান, ‘প্রাকৃতিক জীবচৈত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ ডলফিন এবং হালদা নদীকে রক্ষায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনবার অভিযান পরিচালিত হয়। তাছাড়া বন্ধ করা হয়েছে বালি উত্তোলন ও ইঞ্জিনচালিত বোট চলাচল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে, তা গাঙ্গেয় ডলফিন প্রজাতির। ইংরেজিতে একে বলা হয় গেঞ্জেস রিভার ডলফিন, বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্লাটানিস্টা গেনজেটিকা’। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় হুতুম বা শুশুক। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এই প্রজাতির ডলফিন বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের নদীতে দেখা যায়। এর মধ্যে ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র, বাংলাদেশের পদ্মা, সুন্দরবনের আশেপাশের নদী এবং চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলী এর বিচরণ ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার।