বিশ্ব যখন করোনার ২য় ধাপের ভয়াবহতায় ঠিক তখনই কিছু পেশাজীবীর দাবির প্রেক্ষিতে খুলে দেয়া হয়েছে নিয়মিত আদালত। যে মুহুর্তে করোনা মোকাবেলায় নিরাপত্তার জন্য দেশের প্রায় সব অফিস-আদালত-দফতরে ভার্চুয়াল সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে সেখানে দেশের আদালত ভার্চুয়াল সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গেল মাসে আদালত পাড়া খুলে দেবার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তো দুরের কথা নূন্যতম মানব-জট স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কোনো মেকানিজম নেই। স্পর্শকাতর এ সময়ে চলছে লাগামহীন অসচেতনেতা। সামাজিক দূরত্ব, করোনা, মহামারি, সংক্রমণ, কোভিড-১৯ পজেটিভ, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কোয়ারেন্টিন, মৃত্যু এসব বিষয় যেন আদালতপাড়ায় অবান্তর।
দীর্ঘ ৭ মাস পর খুলে দেয়া বাংলাদেশের প্রতিটা আদালতপাড়ায় জনস্রোত। বিপদজনক এ পরিস্থিতিতে হাজিরা দিতে এসে করোনা সংক্রমনের ভয়াবহ খবর পাওয়া গেলো আদালত পাড়া থেকে। আদালতপাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, নিয়মিত আদালত চালুর পর সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অনেকেই করোনা আক্রান্তের খবর গোপন করে আদালতে আসছেন। তাদের কাছ থেকে বিচারপ্রার্থী এবং অন্যরা দ্রুতই সংক্রমিত হচ্ছেন।
ঘটনাক্রমে জানা যায়, সিআর মামলায় ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন মো: আলমগীর হোসেন। আদালতে হাজিরা দেয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মো: আলমগীর জানান, “দীর্ঘদিন পর আদালত পাড়ায় পৌঁছেই অবাক হয়ে যাই। ভাদ্র মাসের গরম। জীবন যায় অবস্থা! এতো মানুষ! মানুষের ঘন জটের মধ্যেই আদালত ভবনের সিঁড়িতে পড়ে যাই। পেছনের মানুষ ধাক্কাতে ধাক্কাতে আমাকে নিয়ে যায় চার তলায়।” তার কাছ থেকে আরও জানা যায়, আতঙ্ক নিয়ে ‘হাজিরা’ দিয়ে বাসায় ফেরেন আলমগীর হোসেন। পরদিনই সত্যে পরিণত হলো তার আশঙ্কা। তিনি এখন সপরিবারে আক্রান্ত। পরদিনই জ্বর। তিনি বলেন, “সন্দেহবশতঃ করালাম করোনা টেস্ট। কোভিড-১৯ পজেটিভ রিপোর্ট আসে নিজের। একই রিপোর্ট আসে আমার স্ত্রী, এক মেয়ে এবং ড্রাইভারেরও। আরেক মেয়ের টেস্ট করানো হয়নি বিধায় এখনো জানা যায় নায় তার অবস্থা।”
একজন আলমগীর হোসেন শুধুই নন- আদালত অঙ্গনে এসে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন শত শত মানুষ। সশরীরে আদালতে আসায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামও। আক্রান্ত হয়েছেন তার মহুরী এবং তার স্ত্রী। এখন দু’জন দুইরুমে কোয়ারেন্টিনে আছেন।
বিচারিক আদালত থেকে ‘ভার্চুয়াল’ তুলে দেয়ার পর করোনা আক্রান্তের হার এখন আর হিসাবের মধ্যে নেই। আদালত অঙ্গনে আসা বিচারপ্রার্থী, বিচারক, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী, আদালত সহায়ক কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরাও এখন পড়েছে করোনা ঝুঁকিতে। নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার পর এ ঝুঁকি এখন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। নিয়মিত আদালতের পাশাপাশি ভার্চুয়াল আদালতের কোনো অপশন নেই। ফলে প্রবল স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আদালতে আসতে হচ্ছে ভুক্তভোগী শ্রেণি পেশার মানুষকে। যে মানুষটি টানা ৭ মাস বাসায় এক প্রকার কোয়ারেন্টিনে ছিলেন- মামলার প্রয়োজনে তাকে হাজির হতে হচ্ছে আদালতে। দেশের প্রায় সব অফিস-আদালত-দফতরে ভার্চুয়াল সুবিধা সম্প্রসারিত হচ্ছে। অথচ আদালত ভার্চুয়াল সুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন সুপ্রীম কোর্টের একজন সরকারী আইনজিবী বলেন, “নিম্ন আদালতের বিচারকরাই এই করোনা সংক্রামণের জন্যে দায়ী। কারন বিচারকেরা ভাল ভাবেই জানেন স্বাভাবিক ভাবে আদালত চালাতে চাইলে কি পরিমাণ লোকের সমাগম হবে এবং এরা বেশীর ভাগই কম শিক্ষিত লোকজন ফলে স্বাস্থ সম্পর্কে এদের কোন জ্ঞান নেই।
সুপ্রিম কোর্ট বার সূত্র জানায়, সারাদেশের আদালত পরিচালিত সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অধীনে। করোনা সংক্রমণ ক্রমঃবিস্তারের প্রেক্ষাপটে বিধি সংশোধন করে সারা দেশে ভার্চুয়াল আদালত চালু করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে ভার্চুয়াল আদালতে সানন্দে গ্রহণ করেন তরুণ প্রজন্মের আইনজীবীরা। ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি করতে পারেন- এমন আইনজীবীদের কাছে মামলা নিয়ে ভিড় জমান বিচারপ্রার্থীরা। পক্ষান্তরে প্রযুক্তিনির্ভর এ বিচার পদ্ধতির প্রতি অনীহা দেখান সিনিয়র আইনজীবীরা। বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশই ওয়েব ক্যাম চালানো দূরে থাক- টাচ মোবাইলও চালাতে জানে না।
দেশের প্রায় প্রতিটি আদালত পাড়ায় ঘুরে দেখা যায়, সরকার নির্দেশিত ‘স্বাস্থ্যবিধি মানার আকুতিকেই যেন কটাক্ষ করছে আদালত ভবনের এ মানব জট। সরকারী প্রজ্ঞাপন ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে খোদ আদালত পাড়াতেই ভাঙ্গা হচ্ছে আইন। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের মুখেই মাস্ক নেই। যাদের মুখে আছে তাদেরও বেশীর ভাগ যেনো ঠেকায় পড়ে পরতে হয়েছে যেনো মাস্ক একটা মুখে রাখতে হয় তাই রাখা!
কতিপয় পেশাজীবীর দাবির প্রেক্ষিতে খুলে দেয়া হয়েছে নিয়মিত আদালত। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন-মরণ প্রশ্ন যেন এখানে তুচ্ছ। আইন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশাজীবীদের জীবিকাই যেন বেশি গুরুত্ব পেল। করোনা সংক্রমণ রোধে যা ‘আত্মঘাতী’ বলে মনে করেন অনেকে।
“উচ্চ আদালতের মতো করোনা সংক্রমণ রোধে ভার্চুয়াল-রেগুলার দুটোর অপশনই থাকতে পারত”, বলে মন্তব্য করেন
ঢাকা বারের অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান। সেটি না থাকায় মামলা সংশ্লিষ্টদের স্বশরীরে আদালতে আসতে হচ্ছে। মানুষ করোনা ঝুঁকিতে পড়ছেন। তিনি জানান, করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ একটি সার্কুলার জারি করেই যেন দায় সেরেছে। কিন্তু কেউ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করলে কি হবে, কে এটি প্রতিপালনে বাধ্য করবে- সেটি স্পষ্ট নয়। স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছে কিনা তা মনিটরিং করার কেউ নেই।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো: আলী আকবর দৈনিক অপরাজিত বাংলাকে টেলিফোনে বলেন, আমার হাতে এ মুহূর্তে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই যে, আপনাকে কিছু বলতে পারব। এটুকু বলতে পারি, আমরা আদালতগুলোতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার জন্য সার্কুলার জারি করেছি। সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকরা স্বাস্থ্য নির্দেশিকা নিশ্চিত করবেন। নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার পর আমরা এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হোসেন আলী খান হাসান বলেন, “বারের পক্ষ থেকে আমরা কিছু বিধি-বিধান করেছি। মাস্ক ছাড়া কেউ আদালত অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারবেন না। অবাঞ্ছিত ভিড় এড়াতে আইনজীবীদের আইডি কার্ড ঝোলানো বাধ্যতামূলক করেছি। টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। সাবানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা আছে। এর বেশি আমাদের কিই বা করার আছে? সরকারই তো সব ‘স্বাভাবিক’ করে দিয়েছে।”
তিনি আরও জানান, “ঢাকা বারে ২৭ হাজার আইনজীবী। এরই মধ্যে ২৫ জনের বেশি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কত শত আক্রান্ত হয়েছেন তার হিসাব নেই। ভার্চুয়াল ব্যবস্থায় বিচার কার্যক্রমে আইনজীবীরা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এ ব্যবস্থাকে আরও ব্যাপকভিত্তিক এবং স্থায়ী রূপ না নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। ভার্চুয়াল পদ্ধতির বিপক্ষে আইনজীবীরাই আন্দোলনে নামেন। তাদের যুক্তি- না খেয়ে মরার চেয়ে, খেয়ে মরা ভালো। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শুধু আইনজীবী কেন, বিচারক, বিচারপ্রার্থী,সব শ্রেণির মানুষই এখন গণহারে করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কিই বা করার আছে! এখানে জীবনের চেয়ে জীবিকা গুরুত্ব বেশি!” তিনি আরও বলেন, “দেশের মানুষের মাঝে ভয়ের আতঙ্কের এমনকি মৃত্যুর ভয়েও তেমনটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।”
এদিকে আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন আদালতের ৪৪ জন বিচারক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। ১৬৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট আক্রান্ত ২১১ জন। এদের মধ্যে একজন বিচারক ইন্তেকালও করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বারের আইনজীবী ইন্তেকাল করেছেন ৪৩ জনের বেশি।
অনেক বিচারপ্রার্থী সিনিয়র আইনজীবীদের কাছ থেকে মামলার নথি ফেরত নিয়ে তরুণ আইনজীবীদের শরণাপন্ন হন। সরাসরি জীবিকায় টান পড়াতে দেশের আইনজীবী সমিতিগুলোকে ভার্চুয়াল আদালতের বিরুদ্ধে মাঠে নামান। সমিতিগুলো বক্তৃতা-বিবৃতি দেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের প্রতি আবেদন-নিবেদন জানান নিয়মিত আদালত খুলে দিতে। এক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সারা দেশে নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগও অংশত নিয়মিত করা হয়। ফলে উচ্চ আদালতে ভার্চুয়াল বেঞ্চ এবং নিয়মিত আদালত দুটোর অপশনই রয়েছে।
এদিকে আদালত নিয়মিতকরণসহ সব কিছু খুলে দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। অপরাজিত বাংলাকে তিনি বলেন, “আদালতে মানব জট করোনা সংক্রমণের বড় কারণ হতে পারে। এটি আমাদের বাস্তব সমস্যা। এসব দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত ভলান্টিয়ারদের সক্রিয় হতে হবে। আদালতে যারা উপস্থিত হচ্ছেন- সেই জনসাধারণ যেন স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে বাধ্য হন- সরকারকে সেই মেকানিজম করতে হবে।”
বিচারকার্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এখনো আদলতের বিচারকেরা বিচার কার্য স্বাভাবিক ভাবে চালাতে গিয়ে করোনা পরিস্থিতি লেজেগোবরের অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সিনিয়র আইনজিবীদের একগুঁয়েমির কারনে এ পরিস্থিতি লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। বিচার প্রার্থীদের হাজিরা আইনজীবী মাধ্যমে ঘোষনা দিলে মানুষের জীবন মৃত্যু আক্রান্ত ভয় হতে কিছুটা মুক্তি পারেন। খুব দ্রুত এ বিষয় নিয়ে একটি গঠনমূলক সিদ্ধান্তে আসার জন্য আইন মন্ত্রী মহোদয়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।