রাজধানী সমাচার
করোনা পরিস্থিতিতে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর বিভিন্ন রুটের বাস রাস্তায় নামিয়েই গণপরিবহণ শ্রমিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাস্তা গুলোতে গনপরিবহনের সেই আগের চিত্র। কে কার আগে কত বেশি যাত্রী তুলতে পারে এ পালস্নায় নেমে তারা নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে দিন-রাত গাড়ি চালাচ্ছে। ফলে নগরীতে ফের সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। দ্রুত এর লাগাম টেনে ধরা না গেলে গণপরিবহণ শ্রমিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের আশংকা মোটেও অমূলক নয়। তার চিত্র গত কিছুদিনের প্রেক্ষাপটে বুঝা গেছে। শুধুমাত্র চলতি মাসে নগরীর বিভিন্ন রুটে বাসের রেষারেষিতে অন্তত ৫০ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬১ জন আহত হয়েছে। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক, থানা পুলিশ ও নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রাজধানীর গত কয়েকদিনের গণপরিবহণ চলাচলের হালচিত্র পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেরানীগঞ্জের কদমতলী-মিরপুর চিড়িয়াখানা, গাবতলী-মতিঝিল, বাড্ডা নতুন বাজার-মিরপুর আনসার ক্যাম্প, আবদুলস্নাহপুর-মোহাম্মদপুর বছিলা, নবীনগর-মিরপুর-১৪ নম্বরসহ বিভিন্ন রুটের অন্তত ১৫টি স্পট ঘুরে দেখা গেছে পরিবহন শ্রমিকদের বেপোরোয়া কর্মকান্ড।

বেপরোয়া ওভারট্যাক সড়কে প্রানহানীর অন্যতম কারন
এক গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে আরেক গাড়ি রাস্তার সাইড লেনে চলা রিকশার ওপর তুলে দিচ্ছে। কখনো আবার ফুটপাতে হেঁটে চলা পথচারীদের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। এছাড়া গণপরিবহণ চলার সময় দরজা বন্ধ রাখার নিয়ম থাকলেও কোনো বাস-মিনিবাসের চালককেই তা মানছে না। এদিন এ প্রতিবেদকের চোখের সামনেই রামপুরা ব্রিজ, সবুজবাগের মানিকনগর, মোহাম্মদপুরের বছিলা ও মিরপুর-১০ নম্বর সড়কে চারটি দুর্ঘটনা ঘটে। এর প্রতিটি ঘটনাস্থলের আশপাশে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও তাদের স্বক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।

যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠা নামা নিত্য নৈমত্তিক বিষয়
কার আগে কে যাত্রী তুলবেন- এই রেষারেষি রাজধানীর গণপরিবহণের নিত্য দৃশ্য। এরকম বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। বেপরোয়া গতির দুই বাসের রেষারেষিতে গত ৬ আগস্ট বিকালে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে সিআইডির এএসআই জিয়াউর রহমান প্রাণ হারান। এ সময় তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসা কনস্টেবল আতিয়ার রহমানও গুরুতর আহত হন। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশে একই রুটের তিন বাসের পালস্নাপালিস্নর সময় বেপরোয়া গতির আল-বারাকা পরিবহণের ধাক্কায় আবদুর রাজ্জাক রাজু নামে অন্য এক মোটরসাইকেল আরোহীর মর্মান্তিক মৃতু্য হয়। গত ১৯ আগস্ট শনিরআখড়া এলাকায় নগর পরিবহণের একটি দ্রম্নতগামী বাস পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিলে মোটরসাইকেল আরোহী মাসুদ হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রী তোলা নিয়ে দুই বাসের জঘন্য প্রতিযোগিতায় এ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।

যাত্রীদের অসচেতনেতা দূর্ঘটনার অন্যতম কারন
পরিবহন শ্রমিকদের এমন বেপোরোয়া কার্যকলাপে সাধারনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে কিন্ত রাস্তায় পর্যাপ্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও ট্রাফিক থাকা সত্বেও কেন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রাফিক কনস্টেবলরা তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, পরিবহণ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই তারা জোটবদ্ধ হয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। এতে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসব অনিয়ম তারা দেখেও না দেখার ভান করেন। ট্রাফিক আইন কার্যকর করতে গিয়ে গণপরিবহণে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ জন্য উল্টো তাদের দায়ী করেন।
কিন্তু পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন অন্য কথা।
তারা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেন। এছাড়া মালিকদের সঙ্গে তাদের মাসিক চুক্তিও রয়েছে। এ কারণে এসব ছোটখাটো বিষয়ে তারা গুরুত্ব দেন না। তবে ছোট-বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তারা তাদের টুঁটি চেপে ধরেন। ট্রাফিক পুলিশকে পথে পথে চাঁদা দিতে না হলেও রাজধানীর গণপরিবহণের রেষারেষি অনেকাংশে কমতো বলেও দাবি করেন তারা।

রাজধানীর প্রতিটি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় চাঁদা
এ ব্যাপারে অনেকটা একমত পোষণ করে ঢাকা মহানগর পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের একাধিক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই চালককে দুষছে। পুলিশ তাকে ধরে জেলে নিয়ে ভরছে। অথচ চালকরা কেন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন তা খতিয়ে দেখছেন না কেউই।
অন্য দিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেন, যাত্রী তোলা নিয়ে রেষারেষি ঠেকাতে হলে গণপরিবহণ শ্রমিকদের আগে এর মালিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে এ উদ্যোগ বরাবরের মতো শুরুতেই হোঁচট খাবে। তাদের ভাষ্য, নির্ধারিত বেতন না থাকায় চালক ও সহকারীরা বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। যদিও গণপরিবহণ মালিকরা কেউ কেউ এ ব্যাপারে পাল্টা অভিযোগ করেন। তাদের ভাষ্য, নগর পরিবহণের বাসচালক ও হেলপাররা মাসিক কিংবা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে গাড়ি চালাতে চান না। এ নিয়ে তাদের চাপ সৃষ্টি করলে তারা গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে বিভিন্ন স্টপেজে অযথা সময় নষ্ট করেন। যাত্রী কম দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ শ্রমিকরা নিজেরা ভাগাভাগি করে নেন। কখনো আবার গাড়ি নষ্ট দেখিয়ে গ্যারেজে গিয়ে বসে থাকেন। তাই চুক্তি ছাড়া তারা বিকল্প পথ খুঁজে পান না।
তবে পরিবহণসংশ্লিষ্টরা বলেন, মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুললেও মূলতঃ এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং তারা দু’পক্ষই চুক্তিতে গাড়ি চালানো বন্ধের বিপক্ষে।
গণপরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোসহ রাজপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি চুক্তি বা টার্গেটভিত্তিক গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দেন। এর পরদিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গণপরিবহণ মালিকরা কয়েকদিন তা মানলেও সপ্তাহ না ঘুরতেই তারা আগের অবস্থানে ফিরে যান।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন, সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ না থাকায় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। একই কারণে ট্রাফিক পুলিশও গণপরিবহণের নানা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিচালক বলেন, পরিবহণ খাতে মালিক সমিতি এবং শ্রমিক সমিতি যা চাচ্ছে তা-ই হচ্ছে। এসব সমিতির বিপক্ষে গিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার মতো সক্ষমতা এবং জনবল কোনোটাই সরকারি সংস্থাগুলোর নেই।
তাই পরিবহণ শ্রমিকদের লাগাম টেনে ধরতে হলে সবার আগে চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধে মালিকদের বাধ্য করতে হবে। এছাড়া সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক আইন কার্যকর করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।