গত বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দুর্বৃত্তরা সরকারি আবাসিক ভবনে ঢুকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং মাথায় হাতুঁরি দিয়ে মারাত্মক জখম করে মৃত ভেবে ফেলে যায়। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের দু’জন নেতা গ্রেফতার হবার পর এ ঘটনার অনুসন্ধ্যান করতে গিয়ে একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
দৈনিক অপরাজিত বাংলার সরজমিন এ বিষয়ে তদন্তে গেলে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার নেপথ্য কারণের একাধিক বিষয় সামনে চলে এসেছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের একাধিক পক্ষের সাথে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বিরোধের কারনে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। জানা যায়, ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় রাজনীতিতে বিবদমান একাধিক পক্ষের চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, যুবলীগ নেতাসহ অনেকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য যে,এর আগে হামলার ঘটনায় ইউএনও এর ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিন বাদী হয়ে ঘোড়াঘাট থানায় গতকাল ৩ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে অজ্ঞাতনামা চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করলে পুলিশ ও র্যাব এর অভিযানে ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ কষিগারি এলাকার আবুল কালামের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন (৪২) ও একই উপজেলার ওসমানপুর সাগরপাড়া এলাকার আমজাদ হোসেনের ছেলে আসাদুল ইসলাম (৩৫) কে গ্রেফতার করা হয়। এরা দুজনেই স্থানীয় যুবলীগের সক্রিয় নেতা।
ঘটনা প্রেক্ষাপটে জানা যায় যে, দিনাজপুর-৬ আসনে এক ইউএনওর ওপর আগেও হামলা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফরহাদ হোসেনকে বেধড়ক পেটানো হয়। নবাবগঞ্জের ৩৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই ঘটনা ঘটান। হামলাকারীরা সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের অনুসারী বলে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। এবার ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় লোকজন পুরনো সেই হামলার ছায়া দেখছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিনাজপুরে কাজ করেছেন প্রশাসন ক্যাডারের এমন একজন কর্মকর্তা দৈনিক অপরাজিত বাংলাকে বলেন, “দিনাজপুর-৬ আসনের সব উপজেলা কর্মকর্তাকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনৈতিক নানা চাপে থাকতে হয়। মাদক ও সন্ত্রাসপ্রবণ এই এলাকাটিতে পাতি নেতারাও ইউএনওদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সম্প্রতি ইউএনও ওয়াহিদা খানমের উপর হামলার ঘটনাটিও রাজনৈতিক ভাবে জিঘাংসারই প্রতিফলন।”
এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের চিকিৎসার সার্বিক খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে যান। তিনি সেখানে ওয়াহিদার পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। পরিবারের সদস্যরা ওয়াহিদার ওপর কারা হামলা করেছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু না জানাতে পারলেও দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য তাঁর নির্বাচনী এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নানা অনৈতিক চাপে রাখার কথা জনান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ঐ কর্মকর্তাকে।
প্রশাসন ক্যাডারদের একটি সূত্র জানায়, উপজেলায় কর্মরত একাধিক ইউএনও কাজ করতে গিয়ে সংসদ সদস্যদের অনৈতিক চাপ মোকাবেলার বিষয়টি সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে বলে জানান। গত শুক্রবার রাতে প্রশাসন ক্যাডার সদস্যদের একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে এ আশংকার কথা জানানো হয়।
ঘোড়াঘাট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, কোন পক্ষের সঙ্গে কী ধরনের বিরোধ তৈরি হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বলতে পারবেন ইউএনও ওয়াহিদা। তিনি একটু সুস্থ হলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। তার আগে স্থানীয় বিবদমান গ্রুপগুলো এ ঘটনার দায় প্রতিপক্ষের ওপর চাপাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর হামলার ঘটনায় সব পক্ষকে সন্দেহের চোখে রেখে তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন।
পুলিশের এমন আশংকার কথার প্রতিফলন ঘটেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের কথায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশের মতে, ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় ঘোড়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাফে খোন্দকার শাহেনশাহ সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। তাঁর একাধিক অবৈধ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইউএনও ওয়াহিদা।
তবে আপাত দৃষ্টিতে সাধারন স্থানীয় জনগনের সন্দেহের তীর দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের দিকে, কারন অতীতেও এ অঞ্চলের ইউএনওদের উপর রাজনৈতিক আক্রমন হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক দৈনিক অপরাজিত বাংলাকে বলেন, “যুবলীগের জাহাঙ্গীরের ছত্রচ্ছায়ায় এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলা হচ্ছে। তাঁর অপকর্মের বিষয়ে যখনই আমি জানতে পারি, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থানা পুলিশকে বলেছিলাম। এরপর থেকে আমার রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে।” এর আগে ২০১৪ সালে একজন ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে শিবলী সাদিক বলেন, “নবাবগঞ্জের যে ইউএনওর ওপর হামলার কথা বলা হয়, তা ছিল অতিরঞ্জিত। প্রকৃতপক্ষে ওই ইউএনওর কার্যালয় ভাঙচুর হলেও তাঁকে মারধরের ঘটনা ঘটেনি।”
দিনাজপুর-৬ নির্বাচনী এলাকার অধীন চারটি উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত চাপে রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে শিবলী সাদিক বলেন, “এ অভিযোগ একদমই সত্য নয়। বরং আমার এলাকায় পোস্টিং পেতে ইউএনও, ওসিরা তদবির করে।”
সরজমিনে দেখা যায় যে, সীমান্তঘেঁষা দিনাজপুর জেলার বিরামপুর, হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট এই চারটি উপজেলা মাদক কারবারি ও চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুট। এর মধ্যে হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাটকে বলা হয় ঐ জেলার মাদকের রাজধানী। খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, এখানকার চোরাকারবারীরা সবাই স্থানীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন পদে সম্পৃক্ত এবং তারা রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেরাও বেশ প্রভাবশালী। স্থানীয় বড় বড় সরকারদলীয় নেতাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে এসব কথিত নেতারা। আর এর প্রমান পাওয়া গেছে, ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের সদ্যোবহিস্কৃত আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম ও ৩ নম্বর শিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা, যুবলীগ সদস্য আসাদুল ইসলাম—এই তিনজনই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হওয়া ক্যাডার। এঁদের বিরুদ্ধে ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার মূল অভিযোগ করা হচ্ছে।
অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আছে বলে জানা যায় স্থানীয় সূত্রে। জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় বেপরোয়া ছিলেন। গত ১২ মে বিকেলে ইফতারি বিতরণের সময় ঘোড়াঘাট উপজেলা চত্বরে পৌরসভার মেয়র বিএনপি নেতা আবদুস ছাত্তার মিলনের ওপর হামলা চালান তিনি। সে দিন জাহাঙ্গীর আলমসহ চার যুবলীগ নেতাকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তাঁরা ছাড়া পেয়ে যান। একই মাসে সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের ওপরে হামলার চেষ্টা চালান যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম। হামলার পরিকল্পনার কথা জানাজানি হয়ে গেলে জাহাঙ্গীর আলমকে আটক করে ঘোড়াঘাট থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেদিন এমপি শিবলী সাদিক থানায় এসে জাহাঙ্গীর আলমকে চড়-থাপ্পড় মেরে ছেড়ে দেন। এরপর জয়পুরহাটের হিলিতে মাদকসহ আটক হন জাহাঙ্গীর আলম। মাদকসহ জাহাঙ্গীরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পরও ছাড়া পেয়ে যান তিনি। এছাড়াও গত ১৪ মে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা সায়েদ আলীর জামাতা আবিদুর রহমান আওয়ামী যুবলীগ দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের কাছে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগটি ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও আসে। অভিযোগে বলা হয়, উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানা দুই মাস ধরে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা দিতে বিলম্ব হলে কলোনিপাড়া এলাকায় এক একর জমি দখল করে নেন তাঁরা। পরে ইউএনও ওয়াহিদা খানম ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কারণে হামলা হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সরজমিনে ঘুরে দৈনিক অপরাজিত বাংলার প্রতিবেদনে উঠে আসে আরেকটি অবৈধ কার্যক্রম। জানা যায়, দিনাজপুর শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে ঘোড়াঘাট উপজেলা। এ উপজেলায় কোনো সরকারি বালুমহাল না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ঘাট তৈরি করে প্রায় ১০টি জায়গা থেকে লোহার পাইপ বসিয়ে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। দেখা গেছে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের প্রশস্তকরণ কাজ শুরু হবার কারনে বেড়ে যায় বালুর চাহিদা। সেই চাহিদাকে কারনে বালু উত্তোলনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীর আলম, মাসুদ রানা ও আসাদুল ইসলাম। তবে বালুমহালের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বনিবনা হচ্ছিল না তাদের। এতে জাহাঙ্গীর আলমকে বাদ দিয়ে ৩ নম্বর শিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে উঠে। তাদের এ অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম সম্প্রতি ড্রেজার মেশিন পুড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও অবৈধ বালুমহাল বন্ধ করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে অবৈধ এই বালুর টাকার ভাগ পাওয়া স্থানীয় প্রভাবশালী অন্য সব পক্ষ। এ কারণেও ইউএনও হামলা হতে পারে বলে বিশ্বাস করেন সচেতন মহল।
“ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনা নিছক কোনো ঘটনা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর হামলার শামিল। এই হামলাগুলো ঘটছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। আর রাজনৈতিক কারণেই তাঁরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। সে কারণে দিনাজপুরে বারবার ইউএনওদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে” বলে ক্ষোভের সাথে বলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) দিনাজপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বাদল।