বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় নিজের অবস্থান ক্রমেই জোরদার করছেন রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি যেভাবে চাইছেন, ঠিক সেভাবেই ঘটছে সব কিছু। তার চতুর ও কুটচালের কাছে রীতমতো শিশু বনে যাচ্ছেন আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতারা। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন শেষে বিশ্লেষকরা সংশয় জানিয়েছেন, সেখানেও জিততে চলছে পুতিনের নীরব সমর্থকরা।
সবেই শেষ হলো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ভোট। এখনও ফল আসেনি। তবে বলা হচ্ছে, এই নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থীরা রেকর্ড সংখ্যক আসন পেতে যাচ্ছে। যদি পূর্ভাবাস মিলে যায়, তাহলে সেটি হতে যাচ্ছে ব্রাসেলস কেন্দ্রীক ইউরোপীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা, বড় ধরনের অনিশ্চয়তা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রজুড়ে চার দিনের ভোট শেষে বুথ ফেরত জরিপ বলছে, পার্লামেন্টের ৭২০টি আসনের মধ্যে প্রায় ১৫০টি আসনে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো জয়ী হবে, যা সম্ভবত মূলধারা সব দলের পক্ষে আইন পাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন করে তুলবে।
অর্থাৎ, আগের মতো আর একচেটিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না- ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। মধ্যপন্থী, উদার ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলো মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলেও ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়ার নেতাদের জন্য এই নির্বাচনের ফলাফল একটা বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর রেনেসাঁ পার্টি, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ সোলৎজের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি সবচেয়ে বাজে ফল করেছে। দুই দেশেরই কট্টরপন্থী দলগুলো বড় জয় পেয়েছে। যা ইউরোপের রাজনীতিতে অনিশ্চিত করে তুলতে পারে বলা আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইউরোপের পার্লামেন্টে কট্টর ডানপন্থীদের এমন নাটকীয় উত্থানের পেছনে পুতিনের হাত রয়েছে বলে আগে থেকেই অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানির কর্তা ব্যক্তিরা এই নিয়ে হুঙ্কারও ছেড়ে ছিলেন। নির্বাচনের আগেই এই দুই দেশ অভিযোগ করে, ইউরোপের ভোটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে রাশিয়া।
যদিও এনিয়ে কোন মন্তব্য করেনি রাশিয়া। তবে বিশ্লেষকরা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা এবং ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোর হস্তক্ষেপ নিয়ে ক্রেমিলেন আপত্তি শুরু থেকেই ছিলো। কিয়েভের ন্যাটো প্রীতিই এই যুদ্ধকে অবধারিত করেছে বলে অভিযোগ করে আসছেন রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনও।
তখন থেকেই রাশিয়ার থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো ইউরোপের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরিতে সচেষ্ট হয়। তারই অংশ হিসাবে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনকে রাশিয়া টার্গেট করে। ইউরোপের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী এই সংসদে যদি কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ঘটে তাহলে ইউরোপের ন্যাটো প্রীতি বাধাগ্রস্থ হবে।
আর, সেটি রুশ নেতা পুতিন চাইতেই পারেন। পুতিন চাইছেন, ইউরোপে ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান বিস্তারের লাগাম টেনে ধরতে। এরিমধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থাকা যেসব দেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছেন, সেসব দেশের স্নায়ুর উপর হাটাহাটি শুরু করেছেন পুতিন।
এছাড়াও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী দলগুলোকে ক্রমাগত নীরব সহযোগিতা করে যাচ্ছে মস্কো। যারই ফলই এবারের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেখানে কট্টর ডানপন্থীরা বড় জয় পাবার কারণে, এখন থেকে রাশিয়া বিরোধী কোন পদক্ষেপ নিতে দুই বার ভাববে ইউরোপ।
এরিমধ্যে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলন সোলৎজের দলের বড় পরাজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন রুশ রাজনীতিবিদরা। আর ক্রেমলিন বলেছে ইউরোপে বেড়ে উঠছে ডানপন্থী দলগুলো, এতে করে আগামীকে মহাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে।
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন করায় ফ্রান্স ও জার্মানিতে দুই সেতা হাতেনাতে ফল পেয়েছেন। তাদের নীতি যে অগ্রহণযোগ্য সেটা প্রমাণিত হয়েছে। তাদের উচিৎ এখনই পদ ছেড়ে দেয়া, তাদের অবসর নেয়ার সময় হয়ে গেছে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, নির্বাচন শেষে ইউরোপীয় সংসদে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ ইইউ এবং ইউক্রেনপন্থীরা। তবে ডানপন্থী দলগুলোর উত্থান স্পষ্ট হয়েছে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনের সমর্থনকে দুর্বল করতে পারে এমন ইউরোপিয়ান বিভক্তির যে কোনও লক্ষণকে কাজে লাগাতে আগ্রহী মস্কো।
বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে মহাদেশটির জাতিসত্তার আয়না বলা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কোনো দল থেকে ব্যক্তিবিশেষ সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করতে পারেন না। শুধু দলভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দল সম্ভাব্য সংসদ সদস্যদের তালিকা তৈরি করে।
যে কোনো দল তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদ সদস্যপদ লাভ করে। আর সংসদ সদস্য কোটা নির্ধারিত হয় দেশগুলোর লোকসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী। সেই হিসাবে ৮ কোটি ৩৮ লাখ বাসিন্দা-অধ্যুষিত জার্মানির লোকসংখ্যার অনুপাতে সর্বোচ্চ আসন ৯৬। সদস্যরা সব সময় পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।
এআর