মেয়র নাছির অনুসারী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক বহুল বিতর্কিত ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের ধামইরহাট। তার পিতা মৃত নূরুল আবছার চৌধুরী।
সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে রাখার অভিযোগ উঠেছে ডা. ফয়সাল ইকবালের বিরুদ্ধে। বেসরকারি ক্লিনিক মালিকদের পক্ষে নিয়ে সরকারের গৃহিত সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্যভাবে প্রভাবিত করে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ক্ষেত্রকে অস্থিতিশীল করে তোলার অভিযোগ উঠেছে নাগরিক সমাজে।
সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল নগরীর ১২টি বেসরকারী হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করলেও এই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা ক্লিনিক মালিকদের সংগঠনের চিকিৎসক নেতারা। এসময় সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে সামনে এনে বেসরকারি ক্লিনিক মালিকরা নগরীর পরিত্যক্ত একটি হাসপাতলকে করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল করার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
হলি ক্রিসেন্ট নামক ঐ হাসপাতালটি বর্তমানে সরকারের হস্তক্ষেপ ও লোকবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল নির্মাণের অযুহাত দেখিয়ে দীর্ঘ দুই মাস নগরীর বেসরকারি হাসপাতালে কোন ধরনের রোগীর চিকিৎসা দেয়া হয়নি।
বেশ কিছুদিন আগে করোনাযোদ্ধা চিকিত্সক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরুৎসাহিত করে দায়িত্বে থেকে সরকারের অপপ্রচার করার অভিযোগ উঠেছিল ডা. ফয়সলের বিরুদ্ধে। যা শেখ হাসিনা সরকারকে বিব্রত পরিস্থিতি ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিএমএ নেতার চিকিৎসা রাজনীতি, নিরুৎসাহিত হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী ও দায়িত্বে থেকে সরকারের অপপ্রচারে ব্যস্ত ডা. ফয়সল শিরোনামে সংবাদও প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরুৎসাহিত ও উস্কানি দিয়ে ডা. ফয়সল ফেসবুকে লিখেন, ‘দেশ তো দেখি পিপিপিতে সয়লাব, ভিক্ষুকও পিপিপি পড়ে ভিক্ষা করছে। সন্মানিত চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবাকর্মী ভাইয়েরা, লাইভ-এ দেখলাম ১০ লাখের অধিক বিতরণ। আপনারটা পেয়েছেন তো? পিপিপি নয় PPE’
বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার এই নেতা অন্য স্টট্যাসে লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গলা ফাটাইয়া বলতে চাই চট্টগ্রামে কোথাও ১টা N95 মাস্ক সরবরাহ করা হয় নাই। গ্লাভস ও সংকট। পিপিই মান সম্মত নয়।’
২০১২ সালে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার নির্বাচনে ফলগণনার সময় ব্যালটবাক্স কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। নিজের প্যানেলের লোকজনকে জেতাতে ডা. ফয়সাল ইকবাল নিজেই ফল গণনার সময় ব্যালট বাক্স কেড়ে নিয়ে ফলাফল উল্টে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষ আদালতে মামলাও দায়ের করেন। পরবর্তীকালে মামলার রায় বাদীর পক্ষে আসে। ফলাফল কারচুপি করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
তার আমল নামার সামান্য কিছু
১ )সাবেক ছাত্রনেতা রনি হত্যার হুমকি :
বেসরকারি উদ্যোগে করোনা আইসোলেশন সেন্টার উদ্বোধন এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভিন্নভাবে তা প্রভাবিত করিয়ে চট্টগ্রামে চিকিৎসা পরিস্থিতে অস্থির করে চিকিৎসাহীন রোগী মেরে ফেলাসহ ডা. ফয়সলের অন্যান্য অপকর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনিকে এ হত্যার হুমকি দেয়ার মতো লোমহর্ষক অডিও রেকর্ড ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
২ )নারী চিকিৎসককে হুমকি :
গত ১ ফেব্রুয়ারি (২০২০) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসককে ডেকে নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফয়সল ইকবাল চৌধুরী। এ ঘটনায় ওই নারী চিকিৎসক নিজের নিরাপত্তা চেয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর আবেদন জানিয়েও বিচার পাননি।
৩)ডা. নীনাকে অবরুদ্ধ ও লাঞ্ছনার অভিযোগ :
এরও আগে নগরীর ইউএসটিসি’র প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলামের মেয়ে ডা. নীনা ইসলামকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ উঠে ডা. ফয়সাল ইকবালের বিরুদ্ধে। ডা. নীনাকে গালাগাল অপমান-অপদস্ত করে তিন কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেওয়ার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে।
৪ )ডা. ফয়সলের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আন্দোলন :
২০১৮ সালে শিশু রাইফা হত্যার ঘটনায় বেসরকারি হাসপাতালে কথায় কথায় মানুষ জিম্মিকারী উল্লেখ করে ডা. ফয়সল ইকবালের চিকিৎসা সনদ বাতিল করারও কথা উঠেছিল নগরবাসীর এক মানববন্ধন থেকে।
সেদিন মানবন্ধনে বক্তারা বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের অধিকাংশ ডাক্তার সুনামের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু অসাধু চিকিৎসক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছেন। চিকিৎসক নামের কলঙ্ক এসব মানুষ এ পেশার অবমাননা করছেন। তারা চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করছেন। বিএমএকে ব্যবহার করে চিকিৎসক নামধারী ফয়সল ইকবাল চৌধুরী চট্টগ্রামে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করছে।’
তখন ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী ‘সাংবাদিকদের সন্তানকে আর চিকিৎসা দেব না’ মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
৫)গৃহবধুকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি :
এছাড়াও ফয়সাল ইকবালের বিরুদ্ধে এক গৃহবধু হুমকি ধামকি দেওয়ার অভিযোগ নগরীতে আলোচনা জন্ম দিয়েছিল। দেলোয়ারা বেগম নামের ঐ গৃহবধূ অভিযোগ করে করেছিল- ডা. ফয়সাল ইকবাল বিএমএ ভবনে ডেকে নিয়ে গেয়ে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাকে চাপ দেন এবং ঐ নারীকে বলেছিল, চমেক হাসপাতালের ত্রিপল মার্ডার মামলার আসামী আমি। মামলা না তুললে পরিণতি খারাপ হবে বলেও হুমকি দেন বলেও ডা. ফয়সল ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেন।
৬)ক্ষমতার অপব্যবহরের অভিযোগ :
‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সাধারণ ডাক্তার ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনদের কাছে আতংকের নাম ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী। তিনি চমেক হাসপাতালের ডাক্তার না হয়েও সেখানে সদর্পে ছড়ি ঘোরান। চমেক হাসপাতালের নিয়োগ-বদলি, ঠিকাদারি থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন ডা. ফয়সল। তার সবুজ সংকেত না মিললে যেমন কেউ এখানে যোগদান করতে পারেন না, তেমনি চমেক হাসপাতালে কোনো ডাক্তার তার বিরাগভাজন হলে তাকে দ্রুত বদলির শিকার হতে হয়।’- এমনই অভিযোগ উঠেছে চমেক হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।
ডা: ফয়সাল অবশ্য আগেই সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যু, বেসরকারি ক্লিনিক সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে( চমেক) হাসপাতালে টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ও উপমন্ত্রী নওফেলকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে হুমকি এবং জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ব্যঙ্গ করে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস প্রদান সহ নানা ইস্যুতে নিন্দিত।
সর্বশেষ গত জাতীয় নির্বাচনে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সংসদীয় এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মহড়া দেওয়াই তথ্যমন্ত্রী সমর্থক ও এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীরা তাঁর উপর চরম অসন্তুষ্ট।
পুলিশের গোপন প্রতিবেদনটিতে যা আছে ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালটি অনেক দিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল চালু করার জন্য প্রতিটি প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে তিন লাখ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। অনেক শিল্পপতির কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। সব অর্থ ব্যয় হলে হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক ভালো হতে পারত। বেসরকারি হাসপাতাল ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে ফয়সল ইকবাল চৌধুরী জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
পর্যবেক্ষণে যা আছে
ডা. ফয়সাল ইকবাল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে গ্রুপিং রাজনীতিতে ভূমিকা রাখেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক। তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড মহানগর আওয়ামী লীগ ও অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। করোনা সংকটের সময় উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও আ জ ম নাছির উদ্দীন গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করতে দেখা গেছে। ফয়সাল ইকবাল চিকিৎসকদের নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয় বলে বিতর্কিত মন্তব্য করেন এবং চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে দায়িত্বশীল পদে থেকে বিষোদ্গার করেন। প্রথম দিকে বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে অনীহার পেছনে ফয়সাল ইকবালের ভূমিকা রয়েছে। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে কার্যকর না করা এবং দীর্ঘ কালক্ষেপণ করার পেছনে তার দায়-দায়িত্ব রয়েছে। ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনির দায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে ফয়সাল বিএমএতে প্রভাব খাটিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
সুপারিশে যা আছে
ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীকে বিতর্কিত বক্তব্য ও কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া; ফয়সাল ইকবাল কর্তৃক ভয়ভীতি প্রদর্শনের অনুসন্ধানপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বিএমএর মাধ্যমে চিকিৎসকদের সুরক্ষাবিধি মেনে নির্ভয়ে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা; হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে দ্রুত চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ কভিড হাসপাতাল হিসেবে সক্ষমতা তৈরির জন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিক অ্যাসোসিয়েশনকে নির্দেশ দেওয়া ও নিবিড় তদারকির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা এবং অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত মনিটরিং কমিটিতে স্বাচিপ ও বিএমএর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে বেসরকারি হাসপাতালে প্রশাসনিক ও চিকিৎসা কার্যক্রম মনিটরিং জোরদার করার সুপারিশ করা হয়।
ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা স্বীকার করেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হায়দার আলী খান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিশাখার যুগ্ম সচিব উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিএমএ নেতা ডা. মোহাম্মদ ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন পেয়েছি। এটি সচিব স্যারের দপ্তর ঘুরে আমার টেবিলে এসেছে। এটি উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।