দৃষ্যপট যেন অনেকটা এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী ও মঞ্জুরুল আলমের সেই ২০১০ এর মেয়র নির্বাচন। ২০১০ সালে এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীকে হারানোর জন্য একটি শক্তিশালী এন্টি মহিউদ্দীন গ্রুপ তৈরী করা হয়েছিলো সেবার। ১০ বছর পর এসে এবারের চসিক নির্বাচনে তেমন কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেবার মেয়র প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দীনকে এক রকম একা করে ফেলা হয়েছিলো।
তেমনই আরেকটি দৃশ্যের অবতারনায় একা হয়ে পড়ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী। গুরুত্বপূর্ণ অনেক ওয়ার্ডে বিদ্রোহীরা নির্বাচনী মাঠ প্রচারনায় কল্পনাতীত এগিয়ে দলের বিদ্রোহী/স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এসব বিদ্রোহী/স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রত্যেক মিটিং, মিছিল, জনসংযোগে সরাসরি সমর্থন দিতে দেখা যাচ্ছে এলাকার দলীয় নেতা কর্মীদের। এতে করে দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রচারনা বলতে গেলে অনেকটাই নিষ্প্রাণ। আর এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দলের মনোনীত একমাত্র মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর ভোট প্রচানায়।
গত ৬ জানুয়ারী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও চসিকে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ঘোষনা দিয়েছিলেন যে, ৮ই জানুয়ারীর মধ্যে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে না নিলে সংবাদিক সম্মেলন করে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের বহিষ্কারের সময়সীমা পার হয়ে যাবার একদিন পর, “বিদ্রোহী প্রার্থীদের আর সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার করা হবেনা, দলের শৃঙ্খলাভঙ্গ করায় তারা অটো বহিষ্কার হয়ে যাবেন” বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
জনাব ইঞ্জিঃ মোশারফ সাহেবের এমন ঘোষনার পর বর্তমান মাঠে থাকা অাওয়ামী লীগের প্রায় সকল বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যক্রম যেনো আরও বেগবান হয়েছে। তারা নির্বাচনী কার্যক্রমে আরও বেশী সক্রিয় হচ্ছেন। আর এতে অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে দল থেকে মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারনা। এতে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছেন মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে ভোট প্রচারনা।
নগরীর উত্তর হালিশহর, আলকরন সহ বেশ কয়টি ওয়ার্ডে আমাদের আপরাজিত বাংলার প্রতিবেদকের সরজমিন প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে বিদ্রোহীরা এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি চষে বেড়াচ্ছেন। তাদের প্রত্যেকের সাথে প্রতিটি নির্বাচনী মিটিং, মিছিল, জনসংযোগে দেখা যাচ্ছে মহানগর অনেক নেতাদের। এটা অনেক ওয়ার্ডে সাধারন ভোটারের মধ্যে একধরনের বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেছে।
দেখা গেছে নগরীর ৪১টি সাধারণ ও ১৪টি মহিলা ওয়ার্ডে ৫৫টি কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের শতাধিক প্রার্থী আছেন, যেখানে দলীয় মনোনীত প্রার্থী ছাড়াও বাকিরা কোন না কোন ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করছেন। দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে তারা বর্তমানে একক ভাবে বিদ্রোহী/স্বতন্ত্র ব্যানারে নির্বাচন করলেও প্রচারনা মাঠে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তারা আদৌ আওয়ামী লীগের নাকি স্বতন্ত্র!
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে মহানগর বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, “আওয়ামী লীগের প্রতিটি কার্যক্রম আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছি। সে পর্যালোচনায় আমরা আমাদের দল মনোনীত সকল প্রার্থীদের দলের নিয়ম নীতি মেনে চলার জন্য কঠোর নজরদারীতে রেখেছি, ইনশাআল্লাহ আমাদের দলের মধ্যে এমন অরাজকতা আসবে না বলেই আমরা নিশ্চিত।”
বর্তমান চসিক নির্বাচনে আপনাদের বিএনপিতে কি কোন বিদ্রোহী প্রার্থী নেই?-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রত্যেক দলেই কিছু এমন থাকবে এটা স্বাভাবিক। কারন দীর্ঘদিন দলের রাজনীতিতে থেকে অনেক নেতাদেরদেরই একটা আকাঙ্খা থাকে জনপ্রতিনিধি হবেন। এটা দোষের কিছু না। কিন্তু বর্তমান চসিক নির্বাচনে বিএনপি’র নির্বাচনী সাংগঠনিক শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড আওয়ামী লীগ থেকে অনেক বেশী গোছালো ও আজ্ঞাবহ।”
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, “আসন্ন চসিক নির্বাচনে যদি দিনের অর্ধেকটা সময়ও যদি সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নিবিড়ভাবে ভোট দিতে পারেন তাতেই বিএনপি বর্তে যাবে” প্রচুর কাউন্সিলর আসন বিএনপির থাকবে বলে মনে করেন এ নেতা।
২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে মনোনয়ন বঞ্চিত গতবারের কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবু’র এক সমর্থক জানান, “এখানে দল থেকে ইকবাল ভাই মনোনয়ন চাইলে দল মনোনয়ন দেয় নায়, কিন্তু এলাকায় ইকবাল ভাইয়ের প্রচুর জনসমর্থন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২ নং জালালাবাদের একজন আওয়ামী লীগে সমর্থক একজন প্রবীন জানান, “প্রায় ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারনায় বেশ এগিয়ে আছেন। তারা রাত দিন নির্বাচনী কার্যক্রমে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন যেখানে দল মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটাই ম্লান।”
প্রবীন এ ব্যক্তি জানান, “মূলতঃ এমন কার্যক্রমে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে মেয়র প্রার্থী জনাব রেজাউল করিম চৌধুরীর। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কোন্দলে নিজের পাল্লায় ভোটারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়ে চলছেন।”
তিনি আরও বলেন, “২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবুও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এছাড়া সাবেক কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি ফরিদ আহমদ চৌধুরী, বাস্তুহারা লীগ নেতা আনোয়ার হোসেনও এই ওয়ার্ড থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তাদের প্রত্যেকেরই অল্প বেশী সমর্থন এলাকায় আছে। এ অবস্থায় অনেক মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিএনপি প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে আওয়ামী লীগের নিজেস্ব ভোট ব্যাংক চলে যাচ্ছে অন্য ব্যালেটে। যার তেমন কোন সমস্যা নাই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের মধ্যে।”
প্রবীন এ ব্যক্তির সত্যতা পাওয়া গেলো নগরীর ১, ৯, ১১, ১৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩৩ নং ওয়ার্ড গুলোতে। যার প্রায় সব গুলো ওয়ার্ডেই বিদ্রোহীদের তৎপরতা দলীয় প্রার্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, ক্রমেই একা হয়ে যাচ্ছেন মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। কারন বিদ্রোহী প্রার্থী অধ্যুষিত ওয়ার্ড গুলোতে বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করছে স্ব স্ব এলাকার অনেক দলীয় নেতারা, কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে দলীয় প্রার্থীরা অনেকটাই জিম্মি হয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে দলীয় প্রার্থী সমর্থকদের উপর বিদ্রোহী প্রার্থী সমর্থকদের হামলা শুরু হয়ে গেছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে যে ধরনের এ্যাকশানে যাবার প্রয়োজন ছিলো তেমন কিছু করে দেখাতে পারেননি বলে মনে করছেন নগরীর অনেক নেতা-কর্মীরা।