কক্সবাজারের টেকনাফে মেজর (অব.) সিনহাকে যেদিন পুলিশ হত্যা করে, সেদিনই অনেকটা নিরবে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয় আরও তিন যুবককে। হয়তো অজ্ঞাতেই থেকে যেতো এ তিন অভাগা যুবকের লাশের নেপথ্য। কিন্তু দেশি একটি চির সত্য প্রবাদ আছে “আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর”। এ তিন হত্যা কান্ডের মূল নায়ক চকরিয়া থানার ওসি মোঃ হাবিবুর রহমান এবং হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ আমিনুল ইসলাম এর ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ড গোপন থাকেনি শুধু মাত্র মেজর (অবঃ) সিনহার হত্যাকান্ডের কারনে।
বেড়িয়ে আসে ওসি হাবিবুর রহমানের ভালো মানুষী চেহারার অন্তরালের হিংস্রতার ছায়া।
কে এই ওসি হাবিবুর রহমান?
ওসি হাবিবুর রহমান ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশের ডিবি শাখার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি তদন্ত ও পরবর্তিতে একই থানার ওসি প্রশাসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওসি হাবিবুর রহমান চকরিয়া থানার বিদায়ী অফিসার ইনচার্জ বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী কাছ থেকে তাঁর দায়িত্বভার গ্রহন করেন। ওসি প্রদীপ এর মতো তারও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অনেক সম্মান। এই ওসি মো. হাবিবুর রহমান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অধিনে ২০০৪ ও ২০০৯ সালে দু’দফায় প্রায় আড়াই বছর কসবো ও সুদানের দারফোতে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে দু’দফা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা পদকও দেওয়া হয়। কিন্তু মিন চৌকস ও দায়িত্ব দক্ষ পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে উঠে লোমহর্ষক ও পৈশাচিক হত্যার অভিযোগ।
ইতিমধ্যে পুলিশের দাবিকৃত ৫০ লাখ টাকা দিতে না পারায় প্রবাসীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ওসিসহ দুই পুলিশের বিরুদ্ধে পটিয়া আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে। রোববার (১৬ আগস্ট) পটিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ভিকটিমের মামা মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদ শফি মামলাটি দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আসামিরা হলেন চকরিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম।
ক্রসফায়ারে হত্যার রহস্যে জানা যায়, ঘটনাস্থল কক্সবাজারেরই আরেক থানা চকরিয়া। পটিয়া থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া ওমান প্রবাসী জসিম ও দিনমজুরের সঙ্গে চকরিয়ার এক যুবককেও একইসঙ্গে সেদিন ‘হত্যা’ করা হয়।
চকরিয়া থানা পুলিশ সেদিনই সংবাদমাধ্যমে প্রেসবিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানিয়েছিল— ‘কক্সবাজারের চকরিয়ায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৩ মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ওসিসহ ৪ পুলিশ সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৪ হাজার পিস ইয়াবা, অস্ত্র ও গুলি। শুক্রবার (৩১ জুলাই) ভোরে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া বানিয়ারছড়া আমতলী গর্জন বাগান পাহাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।’
কিন্তু ঘটনাটি প্রায় ধামাচাপাই পড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু মেজর (অব.) সিনহা হত্যার ঘটনার পর স্বজনরা আর চুপ থাকতে পারেননি। বেড়িয়ে আসে চাঞ্চলর সব তথ্য।
এখন জানা যাচ্ছে, পরিকল্পিতভাবেই ওই প্রবাসী ও দিনমজুরকে পটিয়ার বাসা থেকে ধরে চকরিয়ায় নিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে চকরিয়া থানা পুলিশ। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন চকরিয়া থানার ওসি মোঃ হাবিবুর রহমান এবং হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ আমিনুল ইসলাম।
নিহতের স্বজন ও স্থানীয়দের দাবি, তারা কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। পুলিশকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের। ঘর থেকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার দেওয়ার আগে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল পুলিশ—এমন অভিযোগও উঠেছে সুনির্দিষ্টভাবে।
সরজমিনে গনমাধ্যমের ঘটনা উদঘাটনে জানা যায়, পুলিশের দাবি করা টাকা দিতে না পারায় নিরপরাধ দুই যুবককে হত্যা করে ইয়াবা উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার তিনদিন আগে পটিয়া থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার পর পুলিশ রহস্যজনকভাবে তাদেরকে ‘অজ্ঞাত’ পরিচয়ে প্রচারণা চালায়।
ঘটনা অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, গত ২৯ জুলাই ভোর ৬টায় পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউপির ভাইয়ের দীঘির পাড় তালতলা এলাকার নিজ বাসা থেকে আব্দুল আজিজের পুত্র মোহাম্মদ জাফর এবং পটিয়া সদরের পাইকপাড়া এলাকার আবুল কাশেমের পুত্র মোহাম্মদ হাসানকে (৩৭) আটক করে চকরিয়া থানা পুলিশ। পরে জাফরের পরিবারের সদস্যদের কাছে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ৩১ জুলাই ভোর রাতে কথিত ইয়াবা উদ্ধারের অভিযানে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছে দাবি করে ৪৪ হাজার ইয়াবা ও ৩০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করার কথা প্রচার করে পুলিশ। এমনকি এ সময় চকরিয়া থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমান, হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম, কনস্টেবল সাজ্জাদ হোসেন ও মো. সবুজ ‘আহত’ হন বলে জানানো হয়েছিল।
নিহত ওমান প্রবাসী জাফর চলতি বছরের ১২ মার্চ দেশে আসেন, তিনি গত ১৮ বছর ধরে ওমান প্রবাসী। এবার করোনা ভাইরাসের কারনে ওমান যেতে পারেন নি। জাফরের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, ‘আমার স্বামী কখনো মাদক ইয়াবার সাথে জড়িত ছিল না। তিনি প্রবাসে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। তিনি খারাপ— এলাকায় কেউ এমন প্রমাণ দিতে পারবে না।
কচুয়াই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, ‘জাফর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা দুরের কথা একটি সাধারণ ডায়েরিও ছিল না, তাকে অন্যায়ভাবে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হাসানের বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর শফিউল আলম আরও বলেন, ‘হাসান একজন দিনমজুর রিক্সা চালক। সে মাদক ইয়াবার সাথে কখনো জড়িত ছিল না।’
এদিকে নিহত দুজনের বিরুদ্ধে মাদক সংক্রান্ত কোন তথ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে নেই বলে গনমাধ্যম নিশ্চিৎ হয়। চট্টগ্রামের (দক্ষিণ) পরিদর্শক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জাফর ও হাসান নামে যে দুজনকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্যের কোন মামলা আছে এই ধরনের তথ্য আমাদের হাতে নেই।’
চকরিয়ায় কথিত অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক আমিনুল ইসলামের কাছে তিনদিন আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা নিহত হওয়ার পর অজ্ঞাত পরিচয়ে কেন প্রচার করা হল—এমন প্রশ্ন রাখা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে চকরিয়া থানার ওসি মোঃ হাবিবুর রহমান~ই ভাল বলতে পারবেন। এর পরপরই ‘জরুরি মিটিং’ আছে বলে লাইন কেটে দেন তিনি। এ বিষয়ে চকরিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ ওসি মোঃ হাবিবুর রহমানের সাথে মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি।
সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রীয় পুরুষ্কার কিভাবে এসব হিংস্র এবং বিচার বহির্ভুত হত্যা করা পুলিশ অফিসারদের দেয়া হয়? প্রশাসন কি তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন? পুলিশ প্রশাসনের কিছু অর্থলোভী, হিংস্র মনোভাবী পুলিশের জন্য পুরো পুলিশ প্রশাসন দায়ী হতে পারে না। এসব জঘন্য মানুষ নামের হায়নাদের আইনের আওতায় এনে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার দাবী সচেতন দেশবাসীর।