অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর সহিংসতা এড়ানো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য যেমন বড় চ্যালেঞ্জ তারচেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো দলে ঢুকে পড়া সুবিধাবাদী হাইব্রিড বহিরাগতদের ঠেকানো যার কারনে দলের ভিতর অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। তার সাথে বাড়ছে জঘন্য অপরাধ। সে পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগ চাচ্ছে চট্টগ্রামে তাদের দলের ঘর গোছানোর কাজটি আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান সহ সকল জেলা-উপজেলা নির্বাচন শেষ হবার পর করতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২ জন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন ঢাকা উত্তর/দক্ষিন আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষাণা করলেও চট্টগ্রামে মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি না দেয়ার কারণ হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
কারণ এবারই প্রথম স্হানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে দলীয় ভাবে। চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছেন, সরাসরি আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্ত চট্টগ্রামে দেখা যাচ্ছে অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার দেয়া মনোনয়নকে অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে মাঠে রয়েছে এবং তাদের পক্ষ কাজ করছেন দলের কিছু নেতা কর্মী যেটি আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্র বিরোধি।
তাই আগামীতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর কমিটিতে এদের স্হান না দেয়াসহ এসব বিদ্রোহী প্রাথীদের বিরুদ্ধে কঠিন ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কমিটি সিটি নির্বাচনের পরে ঘোষণা দেয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের রাজনীতিতে শুরু হয়ে গেছে নেতাদের দৌড় ঝাঁপ। মূলতঃ সম্প্রতি ঢাকা নগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগে বিতর্কিত ও বহিরাগত সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তিদের স্থান পাওয়ায় তার রেশ পরেছে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও দলের অন্যসব অঙ্গসংগঠন নেতাদের মাঝে। অনেক সুবিধাবাদী বহিরাগত ইতিমধ্যে অর্থের দাপটে দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন আসন্ন জেলা, উপজেলা ও নগর, থানা এবং ওয়ার্ড কমিটিতে কিভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করা যায়।
এ পর্যায়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, সরকার চাচ্ছেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও দলের সকল অঙ্গসংগঠনের জেলা, উপজেলা ও নগর,থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান সহ সকল জেলা-উপজেলা নির্বাচনের পর করতে।
দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা যায়, “অপকর্মকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নিয়মিত তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং হচ্ছে। যাঁদের আনুকূল্যে এসব হচ্ছে, তাঁরাও দলীয় পদ হারাচ্ছেন। নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়া হচ্ছে।”
নাম প্রকাশ না শর্তে ঢাকার শীর্ষ একজন নেতা জানান, “দলটির সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ডে এবং মাঠ পর্যায়ে কিছু নেতাদের দলের সাংগঠনিক বিরোধী কর্মকান্ডে সরকার বেশ বিব্রত। তাই দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতারা চাচ্ছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সকল অঙ্গসংগঠনের জেলা, উপজেলা ও নগর,থানা এবং ওয়ার্ড কমিটির ঘর গোছানোর কাজটি আসন্ন চসিক নির্বাচনের পর করার জন্য।”
দলের শীর্ষ পর্যায়ে কেন এ ধরনের চিন্তা ভাবনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটি মূলতঃ মাঠ পর্যায়ে দলের সকল অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীদের কর্মকান্ড কি তা পর্যালোচনা করার জন্য। যারা কমিটিতে আসতে পারেন বলে গুঞ্জন চলছে তাদের কর্মকান্ড নিয়ে দলের হাইকমান্ড কঠোর পর্যালোচনায় আছেন”।
সরকারের এমন চিন্তা ভাবনার সাথে সহমত পোষন করেছেন চট্টগ্রামের অনেক শীর্ষ ও ত্যাগী নেতারা।
শীর্ষ নেতাদের কিছু সূত্র থেকে আভাস পাওয়া গেছে যে, দলের ভিতর কোন সুবিধাবাদী বহিরাগত হাইব্রিড, ক্যাসিনো কারবারের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতা কর্মী, চট্টগ্রাম নগরীতে আলোচিত সমালোচিত ভূমি দস্যু, চাঁদাবাজ, কিশোরগ্যাং থেকে শুরু করে অপরাধী গ্রুপ পরিচালনাকারী কোন ব্যাক্তি যেন দলটির কোন কামটিতে স্থান না পান সেদিক পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
দলটির হাই কমান্ড অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে যাচ্ছেন বলে ঢাকা থেকে দলটির নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা যায়। আর সে কারনেই চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মহানগর কমিটি থেকে শুরু করে থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি নির্বাচনের পর করতে চাচ্ছেন সরকারের উপরের প্রভাবশালী মহল।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম রাজনীতি অঙ্গনের অনেক আলোচিত-সমালোচিত নেতা কর্মীদের গোপন নজরদারীতে আনা হয়েছে। তাদের সকল কর্মকান্ডের অতীত বর্তমান প্রোফাইল তৈরী করছেন দলটির উপর মহলের নির্দেশে।
কেননা সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মোঃ ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রান নাশের হুমকি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্লিনিক ব্যবসা, কমিশন ব্যবসাসহ জ্ঞাতআয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নথি তলব করেছে দুদক। যা নিয়ে খোদ দলটির গভীরে থাকা ব্যক্তিরাই বিব্রত ও লজ্জিত। ডা. মোঃ ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর মতো অসৎ, ভয়ংকর ব্যক্তিরা কিভাবে দীর্ঘদিন ধরে সরকারী দলের ব্যানার ব্যবহার করে এধরনের অপরাধ করে যাচ্ছেন তাও আবার আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে, কার বা কাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ ধরনের কর্মকান্ড করার সাহস পাচ্ছেন তারাও নজরদারিতে আছেন বলে জানা যায় দলটির শীর্ষ মহল থেকে।
সম্প্রতি ক্যাসিনো–বাণিজ্য থেকে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, করোনার নকল সনদ থেকে স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা, ধর্ষণ থেকে রাস্তায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দলটির ব্যানার ব্যবহার করে প্রভাবশালীদের ভূমি দস্যুতা, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, বর্তমানে নগর কমিটির পদে থেকে চাঁদাবাজি, করোনা কালীন সময়ে দলটির পদ ব্যবহার করে সেবার নামে অনৈতিক কর্মকান্ড করার সাথে সম্পৃক্ত নেতাদের কঠোর নজরদারীতে রাখা হয়েছে।
জানা যায়, এ ধরনের নানা অপকর্মে অভিযুক্ত হচ্ছেন সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ। যা সরকারকে দেশে-বিদেশে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করেছে। দলটির নেতারা বলেছেন, দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া নেতা–কর্মীদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাকায় দলটির হাইকমান্ড থেকে অসমর্থিত সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে যে, চট্টগ্রামের রাজনীতিতে শীর্ষ কিছু প্রভাবশালী নেতারাও নজরদারিতে আছেন। কারন কোন নেতার ছত্রছায়ায় কিংবা কেউ নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বহিরাগত সুবিধাবাদীদের দলে প্রবেশ করাচ্ছেন কিনা বা দলের সাংগঠনিক পরিপন্থী কাউকে দলে প্রবেশের চেষ্টা করাচ্ছেন কিনা তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দলের সাংগঠনিক পরিপন্থী কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্তদের নেতৃত্ব শূণ্য করা ও দল থেকে বহিষ্কারের চিন্তা ভাবনা করছে দলটির শীর্ষ পর্যায়।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে একশ্রেণির নেতা-কর্মীর মধ্যে অপরাধে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এঁদের কারণে মাঝেমধ্যেই দল ও সরকার বিব্রত হচ্ছে। কোনো ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রচার না পাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের নেতা–কর্মী বা দুষ্কৃতকারীরা দলীয় পরিচয় নির্বিঘ্নে ব্যবহার করে যান। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করাটা আওয়ামী লীগের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
জানা যায়, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের ব্যানারে থেকে ভূমি দস্যু, নগরীর বিভিন্ন স্পটে চাঁদাবাজি, সুযোগ বুঝে এক দল থেকে অন্য দলে পাল্টি খাওয়া নেতাদের জন্য আওয়ামী লীগ কঠিন সমস্যার মুখোমুখী।
বর্তমানে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বিভিন্ন অপকর্মের সাথে যুক্ত মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের নেতারা পুনরায় কমিটিতে নিজেদের পাকা পোক্ত করার জন্য উপর মহলে বড় ভাইদের দ্বারস্থ হতে শুরু করে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, মহানগর পদের ক্ষমতা দেখিয়ে করে আসা বিভিন্ন অপকর্মে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাদের নাম বারবার আসার কারনে দলটির শীর্ষ নীতি নির্ধারকরা নিজেদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন।
জানা যায়, চট্টগ্রামের বিগত ক্যাসিনো কেলেঙ্কারীতে একের পর এক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নাম সামনে আসায় বিব্রত সরকার চাচ্ছেন দলটির ভাবমূর্তি উদ্ধারের জন্য এসব অপকর্মকারীদের দলে প্রবেশাধীকার ঠেকাতে।
বিশেষ করে দলটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ছাত্রলীগের একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, ধর্ষন, চাঁদাবাজি, মারামারি সহ বিভিন্ন অপকর্মের কারনে দলটির অবস্থান তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। পরে খতিয়ে দেখা যায় যে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অপরাধকারী ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা বহিরাগত কোন দল থেকে এসেছে এবং দলের কোন না কোন প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে দলে পদ নিয়ে বহাল তবিয়তে অপকর্ম করে যাচ্ছেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ মহানগরের বর্তমান পদে থেকে কিছু নেতারা এলাকায় এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরী করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। প্রতিটি স্তর থেকে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। এধরনের নেতাদের ইতিমধ্যে নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে বলে জানা যায়।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের বেশকিছু ছাত্রলীগ, যুবলীগের কেন্দ্রের নেতা-কর্মীদের নাম নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। যারা নিজেরা মহানগর, জেলা, উপজেলার কমিটিতে থেকে মাদকের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে এবং দলের ব্যানার ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবনের সাথে সম্পৃক্ত। দলের এধরনের ব্যক্তিরা যেনো আসন্ন কমিটিতে স্থান না পান তার বিষয়ে সতর্ক থাকছেন শীর্ষ মহল।
এদিকে আরও শোনা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের অনেক সুবিধাবাদী নেতারা চাচ্ছেন নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ সকল অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে, পক্ষান্তরে দলে থেকে এবং দলের পরিচয় বহনকারী ব্যক্তিদের নজরদারিতে ও তাদের কর্মকান্ড পর্যালোচনার জন্য সরকার চাচ্ছেন নির্বাচনের পরেই কমিটির ঘর গোছানোর কাজটি সারতে।
ইতিমধ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় যুবলীগ কমিটিতে দলের ত্যাগী ও মাঠপর্যায়ের অনেকে স্থান না পাওয়া, সিনিয়র-জুনিয়র নিয়ম না মানা, জাপা-বিএনপির নেতাদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া নিয়ে সমালোচনার মুখে দলটির শীর্ষ নীতি নির্ধারকরা।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, “আওয়ামী লীগের মত একটা বড় দলেরতো এই ধরনের সমস্যা হতেই পারে৷ তবে তারা মনে করেন সবাইকে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে৷ যারা মানবেন না, বুঝতে হবে তারা সুবিধাবাদী৷ এদের ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদের সতর্ক থাকতে হবে৷”
তারা আরও বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে দলে এই ধরনের অনেক সুবিধাবাদী ঢুকে গেছে৷ এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা তো আওয়ামী লীগের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটেই৷ নীতি নির্ধারকরা নিশ্চত এ বিষয়ে সতর্ক আছেন৷”