আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে এবার বড় দু’দলের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম (আওয়ামী লীগ) ও ডা. শাহাদাত (বিএনপি)। সে সাথে দু’দল থেকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা তো আছেন। সবদিক মিলে চট্টগ্রামে নির্বাচনের সাজ সাজ রব চোখে না পড়লেও থেমে নেই প্রার্থীদের পদচারনা। বলা যায় যে, “ভোটের মাঠে নেই তারা- তবুও আছেন সবখানে।”
তবে বড় দু’দলের দলীয় দুই প্রার্থীকে জয়ী করতে দু’দলের চার শীর্ষ নেতাদের আবশ্যিক ভূমিকা এখন নগরীতে বেশ আলোচনার বিষয়। বিষয়টি স্বীকার করছেন মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীরাও।
চট্টগ্রাম বিএনপি রাজনীতিতে দুই হেভিওয়েট ব্যক্তি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের আর্শীবাদ আবশ্যিক ডাঃ শাহাদাতকে চমক দেখাতে হলে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে বর্তমান শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে।
তাই আবশ্যিকভাবেই বলা যায়, আগামী ২৭ জানুয়ারির চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে দরকার নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের জয়ী করতে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ‘মহীরুহ’ হয়ে ওঠা এই চার নেতার আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগীতা। শুধু তাই না, দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও জয়ী করতে এ চার নেতার আন্তরিক সমর্থনও একান্ত প্রয়োজন। বিষয়টি যেমন মানছেন নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী প্রার্থীরা তেমনি দল দুটির হাইকমান্ডও জ্ঞাত।
এ পরিস্থিতিতে আসন্ন চসিক নির্বাচনে দল দুটির কেন্দ্রেরও বিশেষ মনোযোগ রয়েছে এই চার নেতার তৎপরতার দিকে। দু’দলের হাইকমান্ড থেকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে তাঁদের নিজের দলের প্রার্থীদের কর্মকান্ডের প্রতি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান শেখ বলেন, “নগরীর রাজনীতিতে এখন থেকে নয় অনেক আগ থেকেই একটা বিভাজন নীতি অনেকটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। প্রয়াত সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিনের সময়কার আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে প্রয়াত আক্তরুজ্জামানের সাথে রাজনৈতিক অনেক বিষয়েই মতবিরোধ ছিলো এ দু’নেতার মাঝে। বর্তমানেও উভয় বড় দলের মধ্যে এটা এখনো দেখা যাচ্ছে। তাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ এ চার নেতা আদৌ শুধু নিজের দলের একমাত্র প্রার্থীটিকে প্রকাশ্যে হয়তো সমর্থন দিচ্ছেন কিন্তু আন্তরিক ভাবে সমর্থন দিচ্ছেন কিনা এ নিয়ে আমি সন্দিজান।”
চট্টগ্রামের এ চার নেতার চসিক নির্বাচনে তাঁদের নিজ নিজ দলের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, “রাজনীতিতে নিয়ামক হয়ে উঠতে হলে লাগে বিচক্ষণতা ও ত্যাগের মানসিকতা। এখন যারা চট্টগ্রামের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক তাদেরও এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। এজন্য পুরো চট্টগ্রামে নিজস্ব একটি ইমেজ দাঁড় করাতে পেরেছেন তারা। নির্বাচনে ভোটারই মূল নিয়ামক। কিন্তু এই ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বড় নেতাদের অনুসারী। প্রার্থীর যোগ্যতার পাশাপাশি নির্বাচনে তাই সিনিয়র নেতাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।”
চট্টগ্রামে টানা তিনবার মেয়র হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির হাল ধরেছিলেন প্রয়াত সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে স্বতন্ত্র একটি ধারাও তৈরি করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর তিন বছর পরও তার জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। এখন চট্টগ্রামে রাজনীতির হাল ধরেছেন তারই বড় সন্তান ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা নওফেল স্থানীয় রাজনীতিতেও সক্রিয় রয়েছেন। জোরালো ভূমিকা রাখছেন পিতার অনুসারীদের এক ছাতার নিচে রাখতে। চসিক নির্বাচনে তাই মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী নামে পরিচিত অনেকেই কাউন্সিলর পদে পেয়েছেন দলীয় সমর্থন। আসন্ন নির্বাচনে নেপথ্যে থেকেও বড় ভূমিকা রাখতে হচ্ছে নওফেলকে।
চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একইভাবে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে তারও রয়েছে অসংখ্য অনুসারী। এবার মেয়র পদে দলের মনোনায়ন না পেলেও নগরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করায় আসন্ন নির্বাচনের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাখতে হবে আ জ ম নাছিরকে।”
তাই আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে রেজাউলকে বিজয়ী করে আনতে হলে নওফেলের মতো নাছিরকেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রামের রাজনীতিতে পরীক্ষিত নাম আ জ ম নাছির ও ব্যারিস্টার নওফেল। দীর্ঘদিন ধরে জনগণের আস্থার প্রতিদান দিয়ে আসছেন তারা। আসন্ন নির্বাচনেও তাই তাদের সব ধরনের সহযোগিতা চাই। আমার বিশ্বাস, উনারা পাশে থাকলে জনগণের ভোটে আমরাই বিজয়ী হবো।”
তবে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমের এমন আশাবাদে সন্দেহ প্রকাশ করছেন নগরীর অনেক মহানগর ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বলেন, “চসিক নির্বাচনে আপাত দৃষ্টিতে দলের নেতাদের একত্র মনে হলেও মাঠ পর্যায়ে তা দেখা যাচ্ছে না। অনেক ওয়ার্ডেই দলের প্রার্থীরা তাদের সিনিয়র নেতাদের পাশে পাচ্ছেন না, এটা দুঃখজনক। এতে লাভবান হচ্ছেন বিরোধী পক্ষ। অনেক ওয়ার্ডে দেখা যাচ্ছে দল থেকে মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজ দলের সিনিয়র নেতাদের পাশে পাচ্ছেন না।”
এদিকে চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতিতেও এখনও বড় ফ্যাক্টর আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান। আমীর খসরু দীর্ঘদিন নগরের সভাপতি ছিলেন। ব্যবসায়ী মহলেও ভালো পরিচিতি আছে তার। বিএনপির স্থায়ী কমিটিরও প্রভাবশালী সদস্য তিনি। চট্টগ্রাম থেকে এমপি নির্বাচন করে বারবার বিজয়ীও হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন মন্ত্রিত্বও। চট্টগ্রামে তাই স্বতন্ত্র একটি ইমেজ তৈরি হয়েছে খসরুর। আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হলে কাজে লাগাতে হবে এই ইমেজ।
স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে একইভাবে চট্টগ্রামে বিএনপি রাজনীতির ‘মহীরুহ’ হয়ে উঠেছেন আবদুল্লাহ আল নোমানও। এই নগরের অলিগলি খুব ভালো চেনা তার। নগর বিএনপির কান্ডারি হয়ে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এখান থেকে বারবার এমপি নির্বাচিত হয়ে পেয়েছেন মন্ত্রিত্বও। ক্লিন ইমেজের অধিকারী আবদুল্লাহ আল নোমানের এই শহরে আছে অসংখ্য অনুসারীও। আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিদলীয় প্রার্থী ডা. শাহাদাতকে চমক দেখাতে হলে তাই আশীর্বাদ লাগবে নোমানেরও।
এ বিষয়ে একমত পোষণ করে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমান পরীক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। দলীয় পরিচয়ের বাইরেও উনাদের আছে স্বতন্ত্র ইমেজ। আসন্ন নির্বাচনে জনসমর্থন বাড়াতে হলে তাদের এই ইমেজও দরকার হবে। তাদের আশীর্বাদ আমার পাশে আছে, পাশে আছে জনগণও।
চট্টগ্রামের চসিক নির্বাচন নিয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তবে সবার মতামতে একটি বিষয়ে তাঁরা একাত্ম যে, নগরীর নেতাদের ভূমিকার উপর নির্ভর করছে দলের মনোনীত প্রার্থীদের ভাগ্য। তাঁদের সকলকে আভ্যন্তরীন ভেদাভেদ ভুলে দল থেকে মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যাক্তিকে শর্তহীন সমর্থন দিতে হবে এবং সে সমর্থন আন্তরিক হতে হবে।