যথাসময়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে-এমন বিষয় মাথায় রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের পরিস্থিতি আরও পাল্টাতে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে নেতাকর্মীদের। এজন্য রাজপথে সতর্কতার মাত্রা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কূটনীতিকদের নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের মন্তব্য না করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এই নির্দেশনা দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক সূত্র জানায়, বিরোধীদের কর্মসূচি ঘিরে এখন যেসব বাস পোড়ানো হচ্ছে সেসব বাসের মালিকদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া ও যারা আগুন দিচ্ছে তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে রাখার কথা বলা হয়েছে। দলীয় নেতাদের ধারণা, যেসব বাস পোড়ানো হচ্ছে সেসব বাসের বেশির ভাগ মালিক বিএনপি-জামায়াতের। দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা নিজেদের বাস পুড়িয়ে ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে।
যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান তাদের এখন থেকেই ভোটারদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দলীয় ঐক্যকে। অন্যদিকে কেন্দ্রের নির্দেশনা ছাড়া নির্বাচনের আগে কোথাও কমিটি ভাঙা বা পুনর্গঠন না করার কথা বলা হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেয়া দলের একাধিক নেতা এসব নির্দেশনার বিষয়টি মানবজমিনকে নিশ্চিত করেন। বৈঠকে নির্বাচনকেন্দ্রিক বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন। কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সদস্য সচিব করা হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। তবে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কে হবেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি দলীয় সভানেত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন দলের নেতারা। এ ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ের মতো এবারো আওয়ামী লীগের নির্বাচন উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে ১৪টি। এতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক সদস্য। এ ছাড়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এতে যুক্ত হবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দলীয় নেতারা জানান, বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের পর স্যাংশনসহ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ভ-ুল করার যে চক্রান্ত এখন চলছে এটা আমাদের যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিহত করতে হবে এবং এদের পরাজিত করতে হবে। এটা একটা নির্দেশনা আছে। আমাদের সভানেত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন যে, বিএনপি’র নেতৃত্বে যে অগ্নিসংযোগ, অগ্নিসন্ত্রাস, বাস পরিবহনে আগুন এসব নাশকতা চলছে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায়; প্রায় প্রতিদিনই বাস পোড়াচ্ছে- এসব নাশকতার জবাবে আমাদের নেতাকর্মীরা সারা বাংলাদেশে সতর্ক পাহারায় রয়েছে।
তাদের আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আমাদের যে আটটি বিভাগীয় কমিটি আছে তারা আরও সক্রিয় হয়ে প্রত্যেক বিভাগে, জেলায় গিয়ে এই সতর্ক পাহারার বিষয়টা আরও জোরদার করবে। আমাদের জেলা সংগঠন, থানা সংগঠন, উপজেলা, ইউনিয়ন, মানে আমাদের তৃণমূলকে আরও সুসংগঠিত করবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয় দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবো। এবার আমাদের মনোনয়ন ফরম যারা সংগ্রহ করবেন আগে ৩০ হাজার টাকা ছিল এবার তাদের ৫০ হাজার দিতে হবে। দলীয় মনোনয়ন কেউ চাইলে অনলাইনেও সংগ্রহ ও জমা করতে পারবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে শিষ্টাচারবহির্ভূত অশোভন আক্রমণাত্মক যে বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের দৃষ্টিগোচরে এসেছে। এজন্য চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চম্বল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ফজলুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে আমরা শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ব্যবস্থা নেবো। এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করা মোটেও উচিত নয়। এ ব্যাপারে আমাদের নেত্রী সবাইকে সতর্ক করে দিতে বলেছেন। সেতুমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে গণতন্ত্র নিয়ে যত কথাই বলুক, গণতন্ত্র কোথাও পারফেক্ট নয়। গণতন্ত্রের ত্রুটি আছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক বড় বড় শক্তিগুলো, যারা নিজেদেরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা ভাবেন তাদের গণতন্ত্রেও অনেক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। আমরা আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে অনেকটা ত্রুটিমুক্ত করেছি।
নির্বাচন নিয়ে যেসব আলোচনা: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের বড় অংশজুড়ে আলোচনায় ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দলের নেতাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খোলামেলা কথা বলেছেন। বিএনপিসহ কোন দল কীভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে কিংবা নেবে না সেসব বিষয় উঠে আসে। প্রথমেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না বলে কয়েক নেতা তাদের মতামত প্রকাশ করেন। সেসব মতামতের ভিত্তিতে তারা যুক্তি তুলে ধরেন। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেসব মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, অপেক্ষা করো, শেষ দিকে হয়তো বিএনপি নির্বাচনে আসবে। তারেকের (তারেক রহমান) টাকা দরকার। সে মনোনয়ন বাণিজ্যের সুযোগ হাতছাড়া করবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, তারা নির্বাচনে এসে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করবে। লক্ষ্মীপুরে যেমন ব্যালটে সিল মারার একটা ছবি তুলে প্রচার হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে এসে এরকম নানা ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা বড় করে দেখিয়ে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করবে। ফলে তারা নির্বাচনে আসবে ধরে নিয়েই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বৈঠকে একাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হয়। এ নিয়ে কয়েক নেতা বক্তব্য দেয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমি চাই বেশি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক, জনপ্রিয়তা যাচাই করুক। নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হোক। দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি আরও বেশি ঝামেলা করার চেষ্টা করবে। নির্বাচনের পরও তারা এগুলো অব্যাহত রাখবে।
ফলে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। তাদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, নির্বাচনের আগেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ভোট হয়ে গেলেও ষড়যন্ত্র হবে। ভোটের পর ষড়যন্ত্রকারীরা নানান খুঁত বের করার চেষ্টা করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করবে। যাতে স্যাংশনসহ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসে। এ ব্যাপারে নেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন তিনি। বিএনপি ও সমমনাদের অবরোধে বাসে অগ্নিসংযোগ, জ্বালাও-পোড়াও নিয়েও কথা বলেন শেখ হাসিনা। যেসব জায়গায় বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জ্বালাও-পোড়াও করছে তাদের নাম, বাবার নাম লিখে তালিকা করার জন্যও নির্দেশনা দেন তিনি। এসব তালিকা নিকটস্থ থানায় জানাতে বলেছেন। পোশাক শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে বাইরের শক্তির পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও প্রবেশ করেছে বলে নেতাদের জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি তাদের চিহ্নিত করার জন্য নির্দেশনা দেন। এজন্য আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শাজাহান খানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তাকে শ্রমিক নেতাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। দেশব্যাপী চলমান গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের (বিএনপি-জামায়াত) আমরা গ্রেপ্তার করবো না তো কী করবো।
আবার অনেকে বলে তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ওই সব দেশে যদি করতো তাহলে তারা কী করতো? তাদের দেশে কী করছে সেটা আমরা জানি, দেখছি। বৈঠকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্য বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। এ সময় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, কূটনীতিকদের ব্যাপারে দলীয় নেতাদের কথা বলার দরকার নেই। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখছে। কোনো প্রয়োজন হলে তারাই কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। সেখানে দেশের অবস্থান জানাবেন। বৈঠকে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শাজাহান খান, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন, গোলাম কবির রাব্বানী চিনু, ড. মুশফিকুর রহমান, সফুরা বেগম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।