সোমবার (৫ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর বনশ্রী এলাকার জি-ব্লকে এক বিশেষ অভিযানে সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টালের প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আবদুস সালামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
জানা যায়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের (আগের ব্যুরো) প্রেস থেকে মেশিনম্যান আব্দুস সালাম মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাঁর খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নুকে দিয়েছেন। জসিমের মাধ্যমে কয়েকজন চিকিৎসক, কয়েকটি কোচিং সেন্টার এবং কিছু ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পেয়ে যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এভাবে মেডিক্যাল ও ডেন্টালে ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চক্রটি।
সিআইডি জানিয়েছে, চক্রটি ২০১৩ ও ২০১৫ সালের সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টালের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছিল। চক্রের মূল মাস্টারমাইন্ড হলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আব্দুস সালাম। ২০১৫ সালে তার নামে একটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আসায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে। চক্রের সঙ্গে পাঁচ-ছয় জন অসাধু চিকিৎসক এবং তিন-চারটি কোচিং সেন্টার জড়িত রয়েছে বলে সালামকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে সিআইডি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ মারফত আরও জানা যায় যে, “চক্রের অনেক সদস্যের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে।” তদন্ত বিভাগ আরও বলেন, “অনুসন্ধান কার্যক্রম সমাপ্ত হলে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে।”
সূত্র মতে, ২০১৩ সাল থেকেই মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস জালিয়াতি চলছে। ২০১৫ সালে এই জালিয়াতির সঙ্গে প্রেসের কর্মী, তাঁদের আত্মীয়, মেডিক্যালের শিক্ষার্থী ছাড়াও চিকিৎসকরা জড়িয়ে পড়েন। এরই মধ্যে অন্তত দেড় শ জনের নাম উঠে এসেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক জেড এম এ সালেহীন শোভন চক্রের অন্যতম হোতা। জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির পাশাপাশি চক্রের সহযোগী হয়েছেন বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদা পারভীন ঋতু, সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের রিয়াদ এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিক্যাল কলেজের মুবিন। মেডিক্যালে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁসের মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ১০ আসামির মধ্যে ছয়জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে অনেক তথ্য উঠে এসেছে বলে জানায় সূত্র।
একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেক প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। এই বিষয়টিও তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি সালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষার আর কেউ জড়িত আছে কি না তা যাচাই করা হবে। একই সঙ্গে যেসব চিকিৎসক ও কোচিং সেন্টারের নাম এসেছে, তাদের ব্যাপারেও ব্যাপকভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার সালামের সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম আলম বলেন, “তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা নেই বললেই চলে। তবে তার নেশা হলো জমি কেনা। তিনি কী পরিমাণ জমির মালিক তা জানার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে গত কয়েক বছরে সাইবার পুলিশের টানা অভিযানে আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় এটা অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। তবে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসে ভর্তি অনেকেই এখন চিকিৎসক। মামলার তদন্ত শেষে পরে জালিয়াতি করে ভর্তি ও পাস করা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, আব্দুস সালামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হবে। এ চক্রে আর কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা করা হবে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদা পারভীন ঋতু, সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের রিয়াদ এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিক্যাল কলেজের মুবিন ভর্তির পাশাপাশি চক্রে সহায়তা করেছেন। এমন আরো অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যারা জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজগুলোকে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে মেডিক্যাল ও ডেন্টালের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং উচ্চ আদালতে রিট করা হলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নাকচ করে দেয়।