যশোরের ঘটনায় সারা বাংলা নির্বাক। যশোর কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া বৃহস্পতিবারের লোমহর্ষক ঘটনা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। নিজের কিশোর সন্তানকে যেখানে পাঠানো হলো সংশোধনের জন্য সেখান থেকে সংশোধন হয়ে ফিরলো লাশ হয়ে।
মানুষের মনে এখন অনেক প্রশ্ন। এটি কী করে সম্ভব হল? কেন এমন হলো? কারা এমন করলো? ঘাতক কেন রক্ষকের দায়িত্ব পায়? বন্দিরা এতটা নিরাপত্তাহীন? সংশোধনের জন্য পাঠিয়ে আর কতো কিশোর লাশ হয়ে ঘরে ফিরবে?
এ নৃশংস হত্যাকান্ডে নিহত স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতাল মর্গের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। কেউই মেনে নিতে পারছে না এমন নৃশংস হত্যা যজ্ঞকে। নিহতের স্বজনরা সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের শাস্তি দাবি জানিয়েছেন। তারা সবাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।ড়
জানা যায় ঘটনার সূত্রপাত চুল কাটাকে কেন্দ্র করে। গত ৩ আগস্ট হেড গার্ড নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলে এক কিশোর বন্দিকে। কিন্তু সে দিন অনেকের চুল কেটে দেওয়ার কারনে কিশোর অসুস্থ অনুভব করায় নূর ইসলামকে ফিরিয়ে দেয়। যশোর বসুন্দিয়ার ফারুক শেখের পুত্র ঈশান ও চুয়াডাঙ্গার পাভেলের স্বজনদের মাধ্যমে জানা যায়, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংশোধনী কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে ১৮ জনকে ঘরের বাইরে এনে দফায় দফায় মারপিট করে। পরে আরো যুক্ত হয় নিম্নমানের খাবার সরবরাহ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন সময় নানামুখী নির্যাতনের বিষয়। ধুমায়িত ক্ষোভ হয় কিশোরদের মাঝে। এরই জের ধরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মিলিতভাবে একে একে ১৮ কিশোরকে রুমের বাইরে এনে হাতা পা বেঁধে রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায় বলে অভিযোগ। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত দফায় দফায় মারপিটের ঘটনা ঘটে। এতে ৩ জন গুরুতর আহত হয়। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে ফেলে রাখা হয়। সন্ধ্যার দিকে তারা মারা যায়। আস্তে আস্তে বিষয়টি আশেপাশের মানুষের কানে আসে। তাদের নেয়া হয় হাসপাতালে। হাসপাতালের ডা. আরিফ আহমেদ দৈনিক অপরাজিত বাংলাকে জানান, মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল ৩ কিশোরকে। নিহতরা হল, খুলনা দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার পুত্র পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), বগুড়া শেরপুরের মহিপুর গ্রামের নূর ইসলাম নুরু মিয়ার পুত্র রাসেল ওরফে সুজন (১৮) ও বগুড়া শিবগঞ্জ থানার তালিপপুর গ্রামের নানু প্রামাণিকের পুত্র নাঈম হোসেন (১৭)।
নিহত রাব্বির পিতা রোকা মিয়া ও মা পারভীন বেগমসহ স্বজনরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
হতাহতদের স্বজনদের দাবি, ভেতরে কিশোরদের ঠিকমতো খাবার দেয়া হয় না, নির্যাতন করা হয়। আহত হয়েছে ১৫ জন। আহত ১৫ জনকে যশোর ২৫০ বেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হল, জাবেদ, ঈশান, আরমান, তাবের, হৃদয়, লেমন, ডাকু, সাইফুল, শরিফুল, নাইম, সাব্বির, হৃদয়, সাফিন, সাকিব, সাব্বির। তারা হাসপাতালে নির্যাতনের যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে।
জানা যায়, আহত কিশোরদের কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। তার মধ্যেও সাংবাদিকরা তাদের কথা শোনার চেষ্টা করেন।
কিশোরদের উপর নারকীয় নির্যাতনের পর অবস্থা বেগতিক দেখে সংশোধন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানান। পরে রাত ৮টার দিকে ডিসি এসপি ও প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘণ্টা কেন বিষয়টি চেপে রাখা হল এর মধ্যে প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে আছে। পরে জানা যায়, সংঘর্ষ নয়, পুরা বিষয়টিই একপক্ষীয়।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি অবহিত হয়েছি। যে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এ ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউই মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে। ঘটনাটি সংঘর্ষ নয়, একপক্ষীয়।
যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের অভ্যন্তরে হতাহতের ঘটনায় কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ‘ক’ সার্কেল মো. গোলাম রব্বানী শেখ। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাকিদের ছেড়ে দেয়া হবে।
এ ঘটনার তদন্তে ঢাকা সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পরিচালক সৈয়দ মো. নূরুল কবীর ও উপ-পরিচালক এস এম মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পিপিএম।
বলা হয়েছে, ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কেন্দ্রের নৃশংস খুনের নেপথ্যের সকল সূত্র উদঘাটন করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ও অন্যান্য কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে কোনরূপ উদাসীনতা, অবহেলা ও গাফিলতি ছিল কি না এবং কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে কী না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনায় আহত ১৪ জন ২৫০ বেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাদের সকল অভিযোগ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ‘আহা উহু’ করছে আহত কিশোররা। তাদের একই কথা কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেছেন।
সবশেষ জানা যায়, যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ঘটনায় জড়িতদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সমাজ সেবামূলক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সহ অনেক সচেতন মহল।