আলজেরিয়ার নাগরিক হিজিয়া তার দুই সন্তান নিয়ে আরো ১৩ জন লোকের সাথে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। স্পেনের আন্দালুসিয়া উপকূলে নৌকাটি ডুবে গেলে নিখোঁজ হন হিজিয়া ও তার ৯ বছর বয়সি সন্তান মোহাম্মদ। বেঁচে যাওয়া হিজিয়ার আরেক সন্তান ওমরের উদ্দ্বৃতি দিয়ে হিজিয়ার বোন নাদার মুখে শুনুন তার বোন ও নয় বছর বয়সি মোহাম্মদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা।
ফ্রান্সের অঞ্জের শহরে স্থায়ী হওয়া আলজেরীয় নাগরিক নাদা বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখ, সর্বশেষ তার বোনের সাথে ফোনে কথা বলেছিলেন। পরের দিন ৩১ তারিখ দিনের শেষ বেলা তিনি বোনকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতে অনেকবার ফোনে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। হিজিয়ার ফোন বন্ধ থাকার সংযোগ পাচ্ছিলেন না নাদা। শনিবার ১ জানুয়ারি সকাল ১১ টায়, নাদা তার মায়ের কাছ থেকে জানতে পারেন হিজিয়া এবং তার ১৪ ও ৯ বছর বয়সি দুই সন্তান সাগরে নিখোঁজ হয়েছে।
৩১ ডিসেম্বর থেকে হিজিয়া ও তার ৯ বছর বয়সি মোহাম্মদ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। ১৪ বছর বয়সি ওমর এই দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি।
উদ্ধার হওয়ার পর ওমর এই ভয়ংকর যাত্রার বর্ণনা দেন।
‘প্রচন্ড কুয়াশায় মা ও ভাইকে চলে যেতে দেখেন ওমর’
নাদা বলেন, “আমার বোন হিজিয়া তার দুই সন্তান ওমর এবং মোহাম্মদকে নিয়ে ৩১শে ডিসেম্বর আলজেরিয়ার উপকূল থেকে একটি ছোট নৌকাযৌগে স্পেনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল৷ তারা উত্তর-পশ্চিম আলজেরিয়ার ওরান থেকে অন্য ১৩ জন যাত্রীর সাথে নৌকায় উঠেছিলেন।”
দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ওমরের সাক্ষ্য অনুযায়ী নাদা জানান, যাত্রার শুরুতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, তাদের খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। যখন তারা স্পেন উপকূলের কাছে পৌছালেন প্রচণ্ড তখন কুয়াশার কারণে সব কিছু ঘোলাটে হতে শুরু করে। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে স্রোতও ছিল অল্প।
যাত্রার এক পর্যায়ে নৌকার পাশে হঠাৎ একটি বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। হয়তো কোন বড় জাহাজ পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, আমি নিশ্চিত জানি না। দুপুর ২টার দিকে নৌকাটি আন্দালুসিয়া উপকূলে উল্টে গেলে সবাই পানিতে পড়ে যায়।”
নৌকা উল্টে যাওয়ার সাথে সাথে হিজিয়া অবিলম্বে তার সন্তানদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি খালি গ্যাসের পাত্র বের করেন যাতে করে তার দুই সন্তান এটিকে ধরে ভেসে থাকতে পারেন। কিন্তু কয়েক মিনিট পর তার ছোট সন্তান মোহাম্মদ গ্যাসের পাত্র ছেড়ে দিলে তাকে স্রোত অন্যদিকে নিয়ে যেতে শুরু করলে হিজিয়াও মোহাম্মদকে খুঁজতে পানিতে ছুটতে শুরু করেন।
মায়ের ছুটে যাওয়া দেখে ওমর স্তব্ধ হয়ে পড়েন। প্রচন্ড কুয়াশায় ও অন্ধকারে তার মা ও ভাইকে চলে যেতে দেখেন ওমর।
২০২১ সালের গ্রীষ্ম থেকে আলজেরিয়ার উপকূল থেকে স্পেন অভিমূখে ভূমধসাগর পাড়ি দেয়ার হার বেড়েছে । শীতকালে ছোট নৌকায় যাত্রা বেশ কঠিন হওয়া সত্ত্বেও পারাপার থামেনি।
শুধুমাত্র ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারির মধ্যে, রেডক্রস ৩১২ জন অভিবাসীকে স্পেন উপকূল থেকে উদ্ধার করেছে। যাদের মধ্যে অনেক মহিলা এবং শিশু রয়েছে।
‘হিজিয়া কেন এমন করেছে আমি জানি না’
নাদা বলেন করেন, “এভাবে পানিতে ভাসা অবস্থায় পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকেন মোহাম্মদ। সকালে একটি বানিজ্যিক জাহাজ তাকে উদ্ধার করে। জাহাজের নাবিকরা যখন ওমরকে উপরে তুলে আনেন তখন সে প্রায় মৃত।
জাহাজে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা, কাপড় ও খাবার দেওয়া হলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেন। জাহাজের লোকেরা তাকে আলজেরিয়ার নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করলে পর্বর্তীতে নৌবাহিনী তাকে পুনরায় আলজেরিয়ার শহর ওরানে ফিরিয়ে আনে। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালে আছেন।”
নাদা আরও বলেন, “সৌভাগ্যবশত আমার মা এই মুহূর্তে ওমরকে দেখাশুনা করতে পারছেন। তিনি স্পেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আপাতত আলজেরিয়ায় ছুটিতে আছেন। আমার মা আমাদের সবার মতো মর্মাহত ও ভেঙে পড়েছেন।”
তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই হিজিয়া ও মোহাম্মদের ব্যাপারে আরও তথ্য পেতে আন্দালুসিয়া অঞ্চলের আলমেরিয়া এবং মুরসিয়া গিয়েছিলেন। তিনি স্থানীয় অধিবাসি ও কর্তৃপক্ষকে হিজিয়া ও মোহাম্মদের ছবি দেখান। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।’’
‘‘হিজিয়া কেন এমন করেছে আমি জানি না। আমি বুঝতে পারছি না আসলে। সে আমাকে অনেকবার বলেছিল আলজেরিয়াতে তার অনেক আর্থিক সমস্যা হচ্ছে। তার কোন চাকুরি ছিল না। দুই সন্তান সহ একজন তালাকপ্রাপ্ত মহিলার পক্ষে এভাবে টিকে থাকা বেশ কঠিন। হিজিয়ার তেমন কোন সম্পদ ছিল না তাই আমরা সবাই তার জন্য টাকা পাঠাতাম।’’
‘‘আমরা একে অপরের সাথে প্রায়ই ফোনে কথা বলতাম, জানান নাদা।
‘‘হিজিয়া প্রায়ই আমাকে বলতেন– ‘আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি, আমার কিছুই নেই। আমার মনে হয় আমি এখানে একজন ক্রীতদাসের মতো বেঁচে আছি।’ কিন্তু সে আমাকে কখনোই বলে নি যে সে এভাবে নৌকাযৌগে সাগর পাড়ি দেবে।”
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ আন্দালুসিয়া উপকূল এবং বালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ হয়ে স্পেনে পৌঁছেছেন। স্প্যানিশ এনজিও সিআইপিআইএমডি-এর মতে, ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত এই পথে মোট ২৭০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। সূত্রঃ ইনফোমাইগ্রেন্টস।
