রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক ছাত্রীদের দেহ ব্যবসায় বাধ্য করানো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ও সিট বাণিজ্যের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বির্বৃতি দিয়েছেন দেশের ২১ নারী অধিকার কর্মী।
সোমবার (৩ অক্টোবর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বির্বৃতিতে তারা এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রীদের দ্বারা যৌন শোষণের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি, মানবপাচার আইনে বিচার ও শাস্তির দাবিও জানান তারা।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ২১ নারী হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকর্মী ও চাকমা সার্কেলের উপদেষ্টা রাণী য়েন য়েন, ভারতের জওহরলালনেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাজনীন শিফা, লেখক ও গবেষক পারসা সানজানা সাজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজলী শেহরীন ইসলাম, থাইল্যান্ডের মাহিডল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মানবাধিকার কর্মী রোজিনা বেগম, নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. নাসরিন খন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা, গবেষক ও এক্টিভিস্ট দিলশানা পারুল, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. নাসরিন সিরাজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার, শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক শ্যামলী শীল, নোয়াখালী নারী অধিকারের সভানেত্রী ও শিক্ষক লায়লা পারভীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক শিল্পী বড়ুয়া, আলোকচিত্রী জান্নাতুল মাওয়া, লেখক ও গবেষক সায়েমা খাতুন, যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. সাদাফ নূর, কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ, লেখক ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ এবং সাংবাদিক ও গবেষক ড.সায়দিয়া গুলরুখ।
বির্বৃতিতে তারা বলেন, ইতিহাসের কি পরিহাস যে যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গুড়িয়ে ফেলার অংশ হিসেবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দেশীয় রাজাকারদের সাহায্যে এদেশের মেয়ে ও নারীদের জোরপূর্বকভাবে তুলে নিয়ে ক্যাম্পে রেখে ৯ মাস ধর্ষণ করেছিল সেই সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইডেন কলেজের নেত্রীদের বিরুদ্ধে তাদের জুনিয়র সহপাঠীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে টর্চার করে পার্টির নেতা বা ব্যবসায়ীদের যৌন উপভোগের জন্য পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে।
তারা বলেন, গত কয়েক দশক ধরে শাসক দল ও তার ছাত্র সংগঠনের মধ্যে একটি অলিখিত চুক্তি গড়ে উঠতে দেখেছি আমরা: শাসক দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-নেত্রী-কর্মীরা শারীরিক ও মতাদর্শিক লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করবে, প্রতিদানে তারা সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির মাধ্যমে ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজ নিজ সম্পদের এমন পাহাড় গড়ে তুলবেন যা বৈধ উপায়ে কোনো মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর পক্ষে সারা জীবনেও অর্জন করা সম্ভব না। উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দলকানা কর্ণধাররা না বোঝার ভান করে থাকবেন, বিনিময়ে তাদের নিজেদের ‘অধ্যক্ষ’ ‘ভিসি’ পদ সুরক্ষিত থাকবে। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-সিট বাণিজ্যের এই সন্ত্রাস ও অপরাধের রাজত্বে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা ভয়াবহ একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছেন: ছাত্রীদের যৌন শোষণের মাধ্যমে তাদের পকেট ও নেতৃত্বের প্রোফাইল ভারি করা।
বির্বৃতিতে আরও বলা হয়, সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে ইডেনে প্রবর্তিত ব্যবস্থার দুটো দিক আছে, দুটোই সমানভাবে ভয়াবহ। ছাত্র রাজনীতি করতে ইচ্ছুক মেয়েদের মধ্যে এই ধারণা বপন করা যে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে হলে নেতাদের সাথে রাত কাটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্রলীগ নেত্রীদের দ্বারা পরিচালিত এই যৌন অপরাধ চক্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নির্দেশ না মানলে টর্চারের সম্মুখীন হওয়া (চড়-থাপ্পড়, মারধর, বিবস্ত্র করে ছবি তুলে ‘ভাইরাল’ করার হুমকি, ‘শিবির’ লেবেল করে হল থেকে বের করে দেয়া ইত্যাদি)। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলীয় কোন্দলের কারণে ফাঁস হওয়া এই কাহিনীগুলো আমাদেরকে নারী আন্দোলন কর্মী হিসেবে বিশেষভাবে সংক্ষুব্ধ করেছে কারণ এই ব্যবস্থার বিস্তার ঘটেছে নারী নেতৃত্বাধীন শাসনামলে। নারী শিক্ষার অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান ইডেন কলেজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখাপড়া করেছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী হয়েছেন। লক্ষণীয়, সরকার এখনও নীরব। (নারী) শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা-বিবৃতি বা উদ্বেগ প্রকাশিত হতে দেখিনি। পদত্যাগ করতে চাওয়া তো দূরের কথা।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটনের সাহসী কাজ একটি বিচার বিভাগীয় কমিটিই করতে পারবে বলে আমরা মনে করি এবং আমরা সেটি গঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি। একইসাথে, ক্ষমতাশালীরা যেহেতু বিষয়টিকে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ইস্যু/সমস্যা হিসেবেই পরিবেশন করছেন, আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২-র প্রতি। যৌন শোষণ একটি আইনী অপরাধ, এবং ইডেনে কলেজে যা যা ঘটেছে তা সত্য প্রমাণিত হলে ১১ নম্বর ধারার অধীনে কঠিনভাবে শাস্তিযোগ্য।
মানব পাচার আইনের ধারা তুলে ধরে তারা বলেন “পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো প্রকারের যৌন শোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানী বা স্থানান্তরের দণ্ড: ধারা-১১। কোন ব্যক্তি জবরদস্তি বা প্রতারণা করিয়া বা প্রলোভন দেখাইয়া কোন ব্যক্তিকে পতিতাবৃত্তি অথবা অন্য কোন প্রকারের যৌন শোষণ বা নিপীড়নমূলক কাজে নিয়োগ করিবার উদ্দেশ্যে বিদেশ হইতে বাংলাদেশে আনয়ন করিলে বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। (মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২)।”