“ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটবে এবং ওই ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলবো।”– হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী।
“এই ধরণের উগ্রবাদী, জঙ্গিবাদী কথাবার্তা বলে তারা ইসলামের মত শান্তির ধর্মকে মানুষের কাছে বিতর্কিত করে তুলছে এবং মূর্খের মত উন্মাদনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। সরকার বা জনগণ কেউই এটি বরদাস্ত করবে না।”
–আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ।
হঠাৎ যেনো দেশের রাজনৈতিক হাওয়ায় অস্থিরতার শীষ শোনা যাচ্ছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের সাংবিধানিক রূপরেখাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর মতো আস্পর্ধায় পর্যবসিত করার জন্য প্রানপণ চেষ্টা চলছে।
যেকোন রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সামাজিক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে মারাত্মক হুমকি হিসেবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রের জন্য বিরাট ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হয়েছে যা ইতিমধ্যে প্রমানিত।
দক্ষিণ এশিয়ার অগ্নি গর্ভ বলে পরিচিত পাকিস্তানই তার প্রমান। তথাকথিত ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার পাকিস্তান ইতিমধ্যে দরিদ্র রাষ্ট্রের কাতারে চলে গেছে। বিশ্বের বৃহৎ গনতন্ত্র দেশের উদহারন ভারতের উন্নয়নও পেছনে হাঁটছে দ্রুতগতিতে। যার একমাত্র কারন সাম্প্রদায়িকতা।
বাংলাদেশেও ধর্মীয় উগ্রতা-সাম্প্রদায়িকতা বর্তমান উন্নয়নকে ভয়ংঙ্কর ভাবে পর্যবসিত করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর ভাস্কর্য-বিরোধী বক্তব্যের দেশের সর্বস্তরে কপাল চিন্তা ভাঁজ ফেলেছে। গেলো শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর তার বক্তব্যে বলেন, যে কোনো “ভাস্কর্য তৈরি করা হলে তা টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলা হবে।”
এ ধরনের আক্রমনাত্মক বক্তব্য ইতিপূর্বে কোন ধর্মীয় সংগঠন করতে পারে নি। যদিও অতীতে বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের মধ্যে ভাস্কর্য নিয়ে মতবিরোধ দেখা গিয়েছিলো।
সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের জন্য ইসলামপন্থী কয়েকটি দল যে দাবি তুলেছে, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে দলটির ঘনিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল বা সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতার রাজনীতির সুযোগ নিয়ে তারা এখন শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের ওপরই আঘাত করছে। যেটা আওয়ামী লীগের জন্যই বিব্রতকর বলে তারা মনে করেন। আর আজকে হেফাজতে ইসলামের আমীরের ভাস্কর্য বিরোধী কট্টর বক্তব্য দেবার পেছনে আওয়ামী লীগের অতীত রাজনৈতিক ধারাও অনেকটাই দায়ী।
যেসব ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সাথে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে সমঝোতা করেছিলো সে দলগুলোই এখন শেখ মুজিবের ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে এর নির্মাণ বন্ধ করা না হলে আরও কর্মসূচি দেয়ার হুমকি দিয়েছে।
চলমান ভাস্কর্য বিরোধী ইসলামী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থায় আওয়ামী লীগের সমমনা কিছু সংগঠন বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ করলেও আওয়ামী লীগের দু’একজন নেতা নিজেদের মতো করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার, “সরকার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে” বলে মন্তব্য করেছিলেন।
কিন্তু শুক্রবার বাংলাদেশ হেফাজত ইসলামীর আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর ভাস্কর্য-বিরোধী বক্তব্যের পরপরই এই প্রথম প্রতিবাদ করে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
প্রায় দুই মাস ধরে ঢাকার ধোলাইপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরি করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে অনেকগুলো ইসলামপন্থী দল সহ হেফাজতে ইসলামীর শীর্ষ নেতার গত শুক্রবার ভাস্কর্য বিরোধী কড়া মন্তব্যের পর শনিবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধে তাদের সরাসরি অবস্থান অবস্থান ব্যক্ত করেন।
ঢাকার ধোলাইপাড় চত্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে অক্টোবর মাসের শুরু থেকেই ইসলামপন্থী কয়েকটি দল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে আসলেও বিষয়টি আলোচনায় আসে ১৩ই নভেম্বর ঢাকায় একটি সম্মেলনে খেলাফত মজলিশের শীর্ষ নেতার বক্তব্যের পর।
শনিবার সকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জুনায়েদ বাবুনগরীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ‘টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলবে বলে কোনো কোনো ধর্মীয় নেতা ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এদেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে আমরা মনে করি। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা করছে।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ জুনায়েদ বাবুনগরীর বক্তব্যকে ‘উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়ানোর অপচেষ্টা’ হিসেবে বিবৃত করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় সংগঠনগুলো এমন ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনের কাছে আগেই পরাস্থ হয়েছিলো বর্তমান সরকার। ২০১৭ সালে ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রীক দেবীর আদলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী কয়েকটি সংগঠনের বিরোধীতার মুখে সেই ভাস্কর্য সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে নতুন নির্মাণ করা ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়েছিলো। তখন সংগঠনটির আমির প্রয়াত আহমদ শফি এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর ভাষায় গ্রিক দেবির মূর্তি স্থাপন করে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যে আঘাত করা হয়েছে।
তবে সেবার সুপ্রিমকোর্ট চত্বরে গ্রীক দেবীর আদলে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধীতা করা হেফাজতে ইসলাম সহ কিছু ধর্মীয় সংগঠনের বিবৃতিকে প্রত্যাখান করে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত মাহবুবে আলম বলেছিলেন “এমন বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন।”
তিনি আরও বলেছিলেন, “ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্য না বুঝে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।”
তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “ভাস্কর্যটিতে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা হয়েছে ন্যায়বিচারের সূচক হিসেবে। দণ্ড বা শাস্তির সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তলোয়ার। আর চোখ বাঁধা রাখা হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে। রোমান আইন থেকেই আমাদের বিচারের বিষয়ের উৎপত্তি। সেজন্যই অন্যান্য দেশের মতো এই ভাস্কর্য করা হয়েছে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেছেন, “হেফাজতে ইসলামের দাবিকে এখন একটু পাত্তা দেয়া হলে তারা পরে দেশের সব ভাস্কর্য নিয়েই প্রশ্ন তুলবে”।
আর ২০১৭ সালে বলা অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত মাহবুবে আলমের কথাই আজকে সত্য হলো।
এদিকে চলমান ভাস্কর্য বিরোধী ইসলামপন্থী যে দলগুলো এখন ঢাকার ধোলাইপড়ে শেখ মুজিবে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে, তার মধ্যে অন্যতম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেছেন, “আওয়ামী লীগ ইসলামী শরিয়তের বিরুদ্ধে কিছু করবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটাই তারা এখন মনে করিয়ে দিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তিনি কিন্তু একটা কথা বলেছিলেন যে শরিয়া বিরোধী কোন আইন তিনি পাস করবেন না এবং শরিয়া বিরোধী কোন পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করবেন না।”
শুধু তাই নয়, সৈয়দ রেজাউল করীম সাহেব ভাস্কর্য এবং মূর্তির মধ্যে কোন পার্থক্য মানতেও রাজি নন।
এদিকে ধর্মভিত্তিক ইসলামী সংগঠনগুলোর এমন আন্দোলনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরিন বলেন, পরিস্থিতির দায় আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তায়।
জোবায়দা নাসরিন বলেন, “আমার কাছে মনে হয়, আওয়ামী লীগ ইসলামী দলগুলোকে আশকারা দিয়ে এপর্যায়ে এনেছে যে এখন আওয়ামী লীগের খোদ নিজের ঘরেই সাপ ঢুকেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ যে কারণে আশকারা দিয়েছে, সেটা হচ্ছে ভোট এবং ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখার জন্য। সেই জায়গায় নিতে নিতে আওয়ামী লীগ এখন এর ফল ভোগ করছে সবচেয়ে বেশি। কারণ আওয়ামী লীগের এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে তারা না পারছে হজম করতে, তারা না পারছে বমি করে ফেলে দিতে।”
অন্যদিকে কিছুদিন আগে কলকাতার এক কালীমন্দিরের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান যেভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, বাধ্য হয়েছেন প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে। আবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারের আড়ালে চিহ্নিত কিছু হিন্দু মৌলবাদী রাজপথে হিন্দুদের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। রাজপথ অবরোধ করেছে।
অন্যদিকে, হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামপন্থী দলগুলো ঢাকার রাজপথে ফ্রান্সবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক শোডাউন করে তাদের যে শক্তিমত্তা দেখিয়েছে তা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র প্রধানরা বাংলাদেশের বর্তমান পেক্ষাপট কিছু ইসলামিক সংগঠনের হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠা নিয়ে শংকিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক নাসিমুল খবিরও মনে করেন, ভাস্কর্য এবং ধর্মীয় প্রতিমা মিলিয়ে ফেলে এসব বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলছিলেন, “ভাস্কর্য এবং ধর্মীয় প্রতিমাকে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজে আছে। সেই সুযোগ নেয় ধর্মীয় উগ্রবাদিরা। এখনও তাই হয়েছে”।
বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। ধর্মভীরু মুসলমানদের কিছু ইসলামপন্থী দলের নেতারা তাদের নিজেদের মতানৈক্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দেশে ধর্মের নামে, ধর্মীয় অনুশাসনের নামে জনগনের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অতি দ্রুত এসব সুযোগ সন্ধ্যানী ও ধর্মকে অপব্যাখ্যা দিয়ে সৃষ্টি করা অরাজকতাকে রুখতে এখনই এসব নামওয়াস্তে ইসলামী সংগঠনগুলোর কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। না হলে অর্থনীতিতে বিশ্বে দ্রুত উদীমান বাংলাদেশ দরিদ্র ও ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হতে বেশী সময় প্রয়োজন হবে না।