তৃনমূল থেকে উঠে আসা কর্মী/নেতা কিংবা দলের ত্যাগী কর্মী/নেতা, এ কথা গুলো রাজনীতির মাঠে বক্তৃতা গরম করার জন্য যথেষ্ঠ আপাদতঃ।
‘হাইব্রীড’ এখন খুব কাঙ্খিত ও কথিত বস্তুনিষ্ঠ একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য!
সম্প্রতি প্রায় দীর্ঘ এক বছর পর ঘোষণা করা হয়েছে যুবলীগের ২০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ দুই ব্যাক্তির সংশ্লিষ্টতা দলের ত্যাগী ও তৃণমূল পর্যায়ে পাশাপাশি পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রশ্ন উঠেছে দলের শীর্ষ নীতি নির্ধারকদের ভূমিকা নিয়ে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া দু’জন হচ্ছেন,
২০১ সদস্যের এই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী “চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা)”
এবং
অন্যজন, ২০০৮ সালে ভোলা -২ বোরহান উদ্দিন-দৌলত খান থেকে জাতীয় নেতা তোফায়েল আহম্মেদের বিরুদ্ধে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করা “ড. আশিকুর রহমান শান্ত”।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সামাজিক অনুষ্ঠানে (লাল দাগ চিহ্নিত) ড. আশিকুর রহমান শান্ত।
মূলতঃ এদের দু’জনের কমিটিতে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না দলের তৃণমূলের ত্যাগী নেতা/কর্মীরা।
চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা)’র কমিটিতে স্থান পাওয়ার পর পরই শুরু হয় নানা গুঞ্জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে কেন্দ্রের অনেকের মধ্যে চলছে নানান সমালোচনা।
অন্যদিকে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে ২০ দল থেকে মনোনয়ন কেনা ও ২০১৩ সালে নিজের বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জুর গড়া বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) থেকে বের হয়ে আসা ড. আশিকুর রহমান শান্ত’র যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নেবার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না দলের নেতা-কর্মীরা।
ড. শান্তর এ পদ পাওয়া নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ক্ষোভের সাথে বলেন “এক সময় যে নাজিউর রহমান মন্জু ভোলার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করেছিল, তার ছেলে পার্থ আমাদের নেত্রীকে কথায় কথায় গালি দেয়-তার ছোট ভাই ডঃ আশিকুর রহমান শান্ত, আর সে পরিবারের একজন দলের পদবি পাওয়াটা অনেক কষ্টের এবং ত্যাগীদের জন্য অপমানজনক।”

বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সদ্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য পদ পাওয়া চৌধুরী মৌসুুমী ফাতেমা (কবিতা)।
মৌসুমীকে নিয়ে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি নুরজাহান বেগম মুক্তা লিখেছেন, “তার (মৌসুমী) ছবি এরশাদ সাহেবের সাথে দেখলাম, খালেদা জিয়ার সাথেও দেখলাম, এমনকি আমাদের নেত্রীর পেছনেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এই নারী তো সুবিধাবাদী, এরা খুবই বিপজ্জনক। এরা আমাদের নেত্রী পর্যন্ত আসে কাদের হাত ধরে??? আসুন এদেরকে চিহ্নিত করি।” ২০১৯ সালে সংরক্ষিত (৩৩৮) আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হতে চেয়ে নমিনেশান দাখিল করেছিলেন মৌসুমী।

২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য নমিনেশান পেপার হাতে চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা)।
জানা যায়, এরশাদের সঙ্গ ছেড়ে নাজিউর রহমান মঞ্জুর গড়ে তুলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। বাবা নাজিউর রহমানের মৃত্যুর পর পার্থই হন চেয়ারম্যান। আর অপর ছেলে শান্তকে রাখা হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে। বস্তুত তখন থেকেই দুই ভাইয়ের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু হয়।
এদিকে তাকে যুব লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য করায় ভোলায় হোন্ডা মহড়া হয়েছে। এই হোন্ডা মহড়ায় দুই চারজন সাবেক ছাত্রলীগের ছাড়া সবাই জাতীয় পার্টির ও বিএনপির লোক ছাড়া কেউ ছিল না। এতে স্পষ্ঠভাবে জেলার আওয়ামীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জেসমিন শামীমা নিঝুম লিখেছেন, “পাকিস্তানি প্রেতাত্মা জামায়াত-শিবির বিএনপির শিকড় বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী রাজনীতির কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে তার প্রমাণ এটা। এতো যাচাই বাছাইয়ের পরেও এরা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করছে। আমার মনে হয় হাইকমান্ড এ ব্যাপারে অবগত নয়। আশা করি ঘটনা সত্য হলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। যতটুকু জেনেছি, মৌসুমী ফাতেমার বড় ভাই রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা যুবদলের সেক্রেটারী। ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (নির্বাহী সদস্য)।”

চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা) যুবলীগের নির্বাহী সদস্য পদ পাবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবি।
এদিকে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার পরই মৌসুমীর কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে অনেকেই নানা মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মৌসুমী তুমি কার?’ ফেসবুকে যে ছবিগুলো শেয়ার করা হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে সোফায় বসেন তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন মৌসুমী। আরেকটি ছবি আছে সেখানে দু’জনেই বসা।
এতে লেখা রয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মৌসুমী কবিতা, স্থান প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন (৬ শহীদ মাঈনুল রোড, ঢাকা সেনানিবাস’ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০২)। দুটি ছবি নিয়েই ফেসবুকে নানাজন নানা রকম মন্তব্য করছেন। যুবলীগের ঘোষিত কমিটিতে শুধু এই মৌসুমীই ‘মৌসুমী’ পাখি হয়ে যুবলীগে প্রবেশ করেননি, কমিটিতে বিএনপিসহ ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের পরিবার থেকেও হয়েছে পদায়ন। এক ঝাঁক সাবেক ছাত্রনেতা স্থান পেলেও পদায়নে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়র। আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলার শীর্ষ পদে আছেন, এমন লোকও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকে শুরু করে ইসি ও সিসির সদস্য হয়েছেন। বাদ যায়নি নানা অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বাদ পড়া বিতর্কিতরাও। এছাড়া স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছে।
এমবি কানিজ নামের একজন খালেদা জিয়ার সঙ্গে মৌসুমীর তিনটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘এই নেন দুই কেন্দ্রীয় যুবলীগের ত্যাগী ট্যাগী সদস্য! কেন রে ভাই দলে ত্যাগী নেতা নেত্রীর অভাব! কতজন গতকাল প্রকাশিত কমিটিতে একটা সদস্যপদ পায়নি বলে বুকের তীব্র ব্যাথা রক্তক্ষরণে ঘুমাতে পারেনি! তাদের পরিবারসহ এই তীব্র দহন হজম করে নেত্রীর পানে চেয়ে সকল ব্যথা লাঘব করে। আর তোমরা এসব কাউয়া পক্ষী রূপ বদলানো, দল বদলানো চরিত্রের লোকদের এতো বড় ঐতিহ্যবাহী সংগঠনে ঢুকিয়ে নিলা নিজের ঘাম জড়ানো রক্ত জড়ানো নেতাকর্মীকে বাঁশ দেয়ার জন্য??? বুঝবা তোমরাও …’
জানা যায়, ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বর ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে আশিকুর রহমান শান্ত ভোলা-২ আসনে নির্বাচনের জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মনোনয়নপত্র কেনেন।
তখন এ প্রসঙ্গে ভোলা-২ আসনের বর্তমান এমপি আলী আজম মুকুল বলেছিলেন, “২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোলা-২ আসন থেকে ২০ দল থেকে মনোনয়ন কেনেন আশিকুর রহমান শান্ত। দল থেকে তাকে মনোনয়ন দেয়া হলেও ভোলা-২ আসনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তার বিপক্ষে কাজ করে বিএনপির কর্মীরা। পরবর্তীতে এ বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির কাছে নালিশ জানালেও কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় বিএনপির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন শান্ত। এমনকি বিষয়টি নিয়ে বিজেপির বর্তমান চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর কাছে ব্যক্তিগত নালিশ জানিয়ে সাড়া না পাওয়ায়, বরং অন্তঃকোন্দলের দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করায় ২০১৩ সালে আশিকুর রহমান শান্ত বিজেপি থেকে সরে আসেন। যার ধারাবাহিকতায় এবার তিনি আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাজনীতি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।” যদিও তখন বিজেপি’র মহাসচিব আব্দুল সাঊদ মতিন বিষয়টি লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেন।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় সক্রিয় ব্যারিস্টার চৌধুরী মৌসুমী ফাতেমা (কবিতা) অনান্য জায়গায়ও বেশ সরেষ। দিক পাল্টে তিনি সরকারের অনান্য অবস্থানে বেশ স্থিতি অবস্থানে আছেন। তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডাবলিউডিবি), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানী লিমিটেড (বিটিসিএল), বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানী লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, রুরাল পাওয়ার কোম্পানী লিমিটেড (আরপিসিএল) এর লিগাল এডভাইজার হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।
রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকতে পারে। তাই বলে এ ধরনের হাইব্রিডের পদ পাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেত-কর্মীদের দলের প্রতি আস্থা এখন অনাস্থার দোলাচলে দুলছে।
এখন রাজনীতি বলতে বুঝায় অর্থ। অর্থ যার পদ তার, আর পদ যার ক্ষমতা তার। সে হউক হাইব্রীড কিংবা অন্যকিছু। সম্মুখ চিত্র ভালো নেই, আসছে সম্মুখে এরাই হবে দলকে জবাই করার ধারালো অস্ত্র।