মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইয়াবা উদ্ধারের হার বেশি হলেও ইয়াবার চেয়ে হেরোইনে আসক্তের সংখ্যাই বেশি। এমনই তথ্য উঠে এসেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে। সংস্থাটি বলছে, দেশের ভেতরে হেরোইনের আধিক্য বেশি রয়েছে রাজশাহীতে, পরের অবস্থানে ঢাকা।
চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া মাদকাসক্তদের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে। দেশে ২০২১ সালে হেরোইনে আসক্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসাদের সংখ্যা ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এটি ২০২০ সালের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
হেরোইন সংক্রান্ত মামলার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, শনাক্ত ও উদ্ধারের হার রাজশাহী বিভাগে ৪৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ২৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ০ দশমিক ৫১ শতাংশ ও বরিশাল বিভাগে ০ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, ২০২২ সালে প্রকাশিত ২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে হিরোইন সেবনকারীর সংখ্যা ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পরবর্তী ধাপে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা ৩০ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং তৃতীয় পর্যায়ে গাঁজা সেবনকারী রয়েছে ২৫ দশমিক ০৯ শতাংশ।
অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০২০ সালে হেরোইন সেবনকারীর সংখ্যা ছিল ২৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ৩৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গাজায় আসক্তের সংখ্যা ছিল ১৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে দেশে মাদক ঢুকছে। তিন দেশের দালাল চক্র ছাড়াও মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে এক শ্রেণির জনপ্রতিনিধিও। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। স্থলপথ ছাড়াও সীমান্ত থেকে নদী পথ ব্যবহার করেও আসছে মাদক।
তথ্য বলছে, রোহিঙ্গাদের মাঝে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসা, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংস্থার অভিযানে ২০২১ সালে হেরোইন উদ্ধার হয়েছে ৪৪১ কেজি, ২০২০ সালে ২১০ কেজি, ২০১৯ সালে ৩২৩ কেজি, ২০১৮ সালে ৪৫১ কেজি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর ও তরুণদের মাঝে মাদকাসক্তের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ বয়সেই বিভিন্ন বিষয়ে তাদের জানার আগ্রহ বেশি থাকে। নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। হয়তো এদের কেউবা আগে থেকে মাদকাসক্ত। তার সঙ্গে চলাফেরার এক পর্যায়ে অন্যরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে পরিবার ও সমাজকে আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে। তা না-হলে বিষয়টি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়াবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে মাদকসহ অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন কৌশলে কারবারিরা রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র মাদক সরবরাহে তৎপর রয়েছে।’ তিনি বলেন, আমরা গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালিয়ে থাকি।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দেশে মাদকের সহজলভ্যতা রয়েছে। এ কারণেও মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। মাদকের সহজলভ্যতা কমাতে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, মানসিক সংকট কাটাতে মাদকের ব্যবহার করা হয়। এটি ভুল পদক্ষেপ। বরং ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে মানসিক সংকটগুলো কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। মানুষের জীবনে সংকট আসবে। কিন্তু তা মাদক দিয়ে নেতিবাচকভাবে কাটানোর চেষ্টা করা ভুল পদক্ষেপ। এ থেকে দূরে থাকতে হবে। বন্ধু কিংবা কাছের স্বজনদের মাদকের প্রতি না বলা শেখাতে হবে। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। না বলার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘বন্ধু মহলের কারণে অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর এক পর্যায়ে তারা মাদকে জড়িয়ে পড়ে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি, কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন সমাজে অপহরণ এমনকি খুন-খারাবির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। ধর্ষণ, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এটা স্পষ্টত বলা যায়, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজ পরিবার, সমাজ ও বৃহৎভাবে রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ বা বোঝা। যে যেভাবে মাদক গ্রহণ করুক না কেন, এর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তখন সমাজে একটি বিকলাঙ্গ পরিবেশ তৈরি হয়। এ জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনা জরুরি।’