বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভিতর ঢুকে পড়া সুযোগসন্ধ্যানী হাইব্রিডদের উপরে তুলে ক্ষমতাবান করার কৃতিত্ব দলেরই শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতাদের। অর্থ ও বিবেকের কাছে বিক্রি হওয়া দলের এসব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিতীনির্ধারকদের কারনে দলের ঐতিহ্য কলঙ্কে পর্যবসিত হচ্ছে। আর তার কিছু নমুনা দেখা গেছে সদ্য সমাপ্ত চসিক নির্বাচনে। কিন্তু এর স্পষ্ঠ দৃষ্যপট দেখা গেলে সদ্য প্রকাশ পাওয়া নগর কর্তৃক অনুমোদিত থানা ছাত্রলীগ কমিটিতে।
চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে ছাত্রলীগের ২৪ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে এমন বিতর্কিত একজনকে— যিনি মাত্র কিছুদিন আগে কলেজের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর ব্যানার ছিঁড়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। তারও আগে মোবাইল চুরি করে খেয়েছিলেন গণপিটুনিও। এই আহ্বায়কের নাম কাজী নাঈম।

চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগ আহবায়ক কমিটির শীর্ষ পদ পাওয়া বিতর্কিত কাজী নঈম।
বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) কাজী নাঈমকে আহবায়ক করে হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের ২৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিতর্কে অনেকেই এভাবে বিতর্কিত ব্যক্তিদের রেখে কমিটি গঠনের সমালোচনায় মুখর। অনেকেই বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ব্যানার ছেঁড়ার অপরাধের পুরস্কার হিসেবে কাজী নাঈম পেলেন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক পদ। কাজী নাঈম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের অনুসারী।
কাজী নাঈমের বিরুদ্ধে শুধু বঙ্গবন্ধুর ব্যানার ছেঁড়াই নয়, রয়েছে মোবাইল চুরির অভিযোগও। ২০১৭ সালে মোবাইল চুরির অপরাধে গণধোলাই খেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতেও দেখা যায় এই নেতাকে। কলেজে বহিরাগতদের নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি ও শিবির কর্মীদের ছাত্রলীগ বানিয়ে নিজের গ্রুপে অনুপ্রবেশের জন্য একাধিকবার খবরের শিরোনামও হন এই ছাত্রলীগ নেতা।
এ বিষয়ে কথা বলতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দস্তগীরকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আবার আহবায়ক কমিটির সদস্য পদে মোজাম্মেল হোসেন রিয়াদকে রাখা হয়েছে যাকে কিনা আবার কেউ কোনদিন ছাত্রলীগের কোন কর্মকান্ডে দেখেইনি। সদ্য সমাপ্ত চসিক নির্বাচনের প্রচারনা চলার সময় কিছুদিন সোঅফ করে কমিটিতে নিজের পদ করে নেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্রলীগ কর্মী বলেন,”মোজাম্মেল হোসেন রিয়াদকে কখনো ছাত্রলীগ করতে দেখিনি। সে কিভাবে কমিটিতে পদবী পায়?!” তিনি ক্ষোভের বলেন, “অনেক ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা হালিশহর থানায় আছেন, যারা শুধু থানা কমিটিতে না বরং সরাসরি মহানগর কমিটিতে পদ নেয়ার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু যোগ্যদের বাদ দিয়ে বহিরাগত, অছাত্র, বখাটে, মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টদের কমিটিতে রাখা হলো। এমন রাজনীতি করার চেয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা অনেক ভালো।” মূলতঃ মোজাম্মেল হোসেন রিয়াদ এবং কমিটি সদস্য শিবলু কুমার নাথ এরা কোন কালেই সক্রিয ছাত্র রাজনীতি করেনি, বলে জানান এ ছাত্রলীগ কর্মী।
আবার হালিশহর থানা ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটির ৭ নম্বর যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে রাখা হয়েছে হাবিব সাহেদকে যার বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ।
তবে সবচেয়ে বেশী বিনোদনের খোড়াক জুগিয়েছে হালিশহর থানা আহবায়ক কমিটির ২৬ নং ওয়ার্ডের আশিকুল ইসলামের নামটি। তাকে কমিটির ১০ নং যুগ্ম-আহবায়ক করা হয়েছে। তালিকায় ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া (তবে অনেকের মতে অছাত্র) কিশোর গ্যাং এর সদস্য বখাটে আশিকের নাম দেখে অনেকের চোখ কপালে উঠে গেছে। ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, “ছেলেটির বয়স ১৫ এর কাছাকাছি বা তারও কম হতে পারে। অল্প বয়সে বখাটে হিসেবে এলাকার সবার কাছে পরিচিত। কিছুদিন আগে চসিক নির্বাচন পূর্বে নির্বাচনী প্রচারনার টাকা ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুই কিশোর গ্যাংয়ের এক রক্তারক্তি সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের ছুড়িকাঘাতে আশিক জখম হয় এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ নিয়ে হালিশহর থানায় মামলাও হয়েছে। উক্ত ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও গনমাধ্যমে বেশ লেখালেখি হয়। এদিকে আশিকুল ইসলামের কমিটিতে পদ পাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর নেতীবাচক আলোচনা হচ্ছে। এমনি একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী আশিকুল ইসলামের ছবি পোষ্ট করে লিখেন, “৮ম শ্রেণীর ছেলে কমিটিতে আসতে পারলে আর আমরা কি রাজনীতি করেছিলাম???”

৮ম শ্রেণীর ছাত্র (অনেকের মতে অছাত্র) ১৫ বছরের আশিকুল ইসলাম হালিশহর থানা ছাত্রলীগ আহবায়ক কমিটির ১০ নং যুগ্ম-আহবায়ক। ছবিঃ ফেসবুক থেকে এক তৃণমূল ছাত্রলীগ কর্মীর আবেগঘন স্ট্যাটাস।
এই যখন ছাত্রলীগের টালমাটাল অবস্থা ঠিক তখনই চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া ও পাহাড়তলী থানা এবং হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক মহানগর ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এই পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বৃহস্পতিবার রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মিতুন মল্লিক ও যুগ্ম সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল স্বাক্ষরিত এসব পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বাকলিয়া থানা ৭১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি, পাহাড়তলী থানায় ৮১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। বাকলিয়া থানায় শহিদুর রহমান মানিককে আহ্বায়ক, পাহাড়তলী থানায় সাজিদ হোসেন সাক্ষরকে সভাপতি ও কাজী রবিউল ইসলাম শহীদকে সাধারণ সম্পাদক এবং মহসিন কলেজে বোরহান উদ্দিন ইমনকে সভাপতি ও রবিউল ওয়াহব কমলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
কমিটি নিয়ে এমন কাণ্ডে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘মহসিন কলেজ শিবিরমুক্ত করার সময় যারা ছিলে কিন্তু আজ বাদ দেওয়া হয়েছে, আবার যাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার জন্য তোমাদের আজ এ পরিণতি। আমি বিশ্বাস করি, মহিউদ্দিন ভাই ঐ পাড় থেকে সবকিছু দেখছেন।’
ক্ষোভের সুরে মহসিন কলেজ কমিটির সদ্য নির্বাচিত এক সদস্য বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার মত একটি গুরুতর অপরাধ করেও ন্যূনতম শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাকে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া হল, এতে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা হতাশই হয়েছেন। নিজেদের কমিটি ভেঙে যাওয়ার আভাস শুনে একদিনেই তড়িঘড়ি করে টাকার বিনিময়ে মহসিন কলেজ সহ থানা, ওয়ার্ড মিলে ১৩টি কমিটি অনুমোদন দিয়েছে মহানগর ছাত্রলীগ। একদিনে এতগুলো কমিটি অনুমোদন দেওয়াটাও একটা রেকর্ড।’
এর আগে চট্টগ্রাম কলেজে মাহমুদকে সভাপতি ও সুভাষ মল্লিক সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি দিয়ে বির্তকের মুখে পড়ে মহানগর ছাত্রলীগ। অছাত্র, বহিরাগত ও বিএনপি কর্মীদের নিয়ে কমিটি গঠন করার অভিযোগ ওঠে ইমু-দস্তগীরের বিরুদ্ধে। ইয়াবা ব্যবসার দায়ে জেল খাটা ও চট্টগ্রাম কলেজে না পড়েও সেই কমিটিতে স্থান হয়েছিলো একাধিক বিতর্কিত নেতার। ওপরমহলের নেতাদের ও ‘মাই ম্যান’দের কমিটিতে আনতে বির্তকিত কমিটি দিয়ে এবার বিতর্কিত কমিটি দেওয়া হল: মহসিন কলেজে— এমন অভিযোগ।
এর আগে বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর নগরীর ১২টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করেন। এগুলো হলো-বাকলিয়া থানা, চকবাজার থানা, হালিশহর থানা, বায়েজিদ থানা, পাহাড়তলী থানা, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ১২ নম্বর সরাই পাড়া ওয়ার্ড এবং ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ড।
নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মিথুন মল্লিক অপরাজিত বাংলাকে বলেন, ইমু-দস্তগীর ঘোষিত কমিটিতে আমাদের পক্ষের কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই আমরা আপাততে তিনটি ইউনিটে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেছি। পরে বাকি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করা হবে।
মহসিন কলেজের পাল্টা কমিটির সভাপতি বোরহান উদ্দিন ইমন ও সাধারণ সম্পাদক রবিউল ওয়াহব কমল নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর ঘোষিত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদেও আছেন। ইমু-দস্তগীরের কমিটিতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক ছয় নেতাকে স্থান দেওয়া হয়। তারা ওই কমিটি থেকে পদত্যাগ করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
নগরের তৃনমূল নেতাদের মতে, আজকের এ অবস্থার জন্য দায়ী দলটির নীতি নির্ধারকরা, কারন উপর মহলে বারবার বলা সত্বেও ত্যাগীদের বিষয়ে নূন্যতম দয়া দেখান হয় নাই। বরং সুযোগ সন্ধ্যানীদের দায়িত্ব দিয়ে দলটিকে লজ্জার নিম্ন স্তরে নামিয়ে এনেছেন। দলের ভিতর থাকা চামচিকা যারা অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে জামাত-বিএনপি, মাদক ব্যসায়ীদের এনে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন তাদের কারনে আজকে এতো অরাজকতা। আর দলের ভিতর এসব লজ্জাজনক কর্মকান্ডে মুখ টিপে হাসছে বিরোধী পক্ষ।
