রাজধানীর গুলশানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ আট আসামির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ তৃতীয়বারের মতো পিছিয়েছে। রোববার (২১ নভেম্বর) এটি দাখিলের জন্য দিন ধার্য থাকলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক গোলাম মুক্তার আশরাফ উদ্দিন প্রতিবেদন জমা দেননি। তাই প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৮ ডিসেম্বর দিনটি নতুন করে ধার্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা।
দেশজুড়ে আলোচিত এ মামলার বাদী ও ভিকটিম মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার তারিখ কেবল ঘুরছে। অথচ গত প্রায় আড়াই মাসেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে পারেনি তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
নুসরাত বলেন, মামলার প্রধান আসামি মুনিয়ার প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরকে উচ্চ আদালতও আগাম জামিন দেননি। তারপরও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। অথচ গত ১২ নভেম্বর রাতে আনভীর লন্ডনে গেছেন এবং এখনো সেখানে অবস্থান করছেন। একটি আলোচিত হত্যা-ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি কীভাবে দেশত্যাগ করতে পারেন, তাহলে কী অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার কাছে আইন-আদালত সবই অসহায়? অপর আসামিদের গ্রেফতারেও কোনো প্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়েনি। এসব ঘটনায় পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে আমাদের পরিবার ছাড়াও জনমনে নানা নেতিবাচক প্রশ্ন উঠেছে বলে জানান মামলার বাদী।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই মুনিয়া মৃত্যুর মামলাটি তদন্ত হচ্ছে। একাধিকবার কুমিল্লায় গিয়ে সাক্ষীদের ও বাদীর জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তবে প্রধান আসামি বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি তাদের জানা নেই। তবে তার বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে অনেক আগেই আদালতে আবেদন করেছে পিবিআই। কিন্তু আদালত কোনো আদেশ দেননি। সব আসামির বিরুদ্ধে অকাট্ট তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। রিমান্ডে পিয়াসাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আনভীরের অপকর্মের সহযোগী- যার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মুনিয়ার কাছে ১০ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছিল, সেই গোলাম হোসেন ওরফে বিগম্যাককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলেই যেকোনো সময় যেকোনো আসামিকে গ্রেফতার করা হতে পারে।
এদিকে আদালত সূত্র জানায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা কন্যা মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগের মামলায় এর আগে গত ২ নভেম্বর একই আদালত ২১ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটি দিতে ব্যর্থ হয় পিবিআই। আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এ নিয়ে পিবিআই তিনবার সময় চেয়ে আবেদন করল। এই মামলায় একমাত্র কারাবন্দি আসামি কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে গত ৩ অক্টোবর গ্রেফতার দেখানো হয়। ওইদিন আদালত তার দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। পরবর্তীতে পিয়াসাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কুমিল্লার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ আদালতে মামলা করেন মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। ওই আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ বেগম মাফরোজা পারভীন মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে পরের দিন গুলশান থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) (২)/৩০ ধারা এবং ৩০২/৩৪ ধারায় মামলাটি (নম্বর-৫) রেকর্ড হয়। মামলা রেকর্ড হওয়ার পর তদন্তের জন্য পিবিআইয়ের কাছে পাঠানো হয়।
এই চাঞ্চল্যকর মামলায় প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর (৪২)। পাশাপাশি তার বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (৭০), মা আফরোজা সোবহান (৬০), আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা (৪০), হুইপপুত্র শারুনের সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মিম (৩৫), কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, পিয়াসার বান্ধবী ও ঘটনাস্থল গুলশানের ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী শারমিন (৪০) ও তার স্বামী ইব্রাহিম আহমেদ রিপনকে (৪৭) আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে শারমিন ও রিপন উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। তবে আনভীরকে আগাম জামিন দেননি হাইকোর্ট বিভাগ।
ভিকটিম মুনিয়ার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া বলেন, হত্যা ও ধর্ষণ মামলার আসামি হয়েও প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর সোবহান গত সপ্তাহে দেশের বাইরে গেছেন। দেশে থাকলেও তিনি অনেকটাই প্রকাশ্যে ছিলেন। দেশত্যাগের আগের দিনও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি নতুন সিমেন্টের লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। এর কিছুদিন আগে গুলশানের ওয়েস্ট ইন হোটেলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির অনুষ্ঠানসহ বেশ কিছু প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে। অথচ আসামিকে গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
গুলশান-২ নম্বর এভিনিউর ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর প্লটের বি/৩ ফ্ল্যাটে একা থাকতেন মুনিয়া। চলতি বছরের মার্চে এক লাখ টাকা মাসিক ভাড়ায় তিনি ওই বাসায় ওঠেন। গত ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় ওই ফ্ল্যাট থেকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ২২ বছর বয়সী কলেজছাত্রীর বড় বোন নুসরাত বাদী হয়ে গুলশান থানায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে মামলা করেন।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, মুনিয়ার সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক ছিল আনভীরের। তিনিই ওই তরুণীর বাসা ভাড়া পরিশোধ করতেন। ওই বাসায় আনভীরের নিয়মিত যাতায়াত করার সিসি ক্যামেরার ফুটেজও উদ্ধার করে পুলিশ।
কিন্তু গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল হাসান গত ১৯ জুলাই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে জানান, মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে আনভীরের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। ১৮ আগস্ট আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন ও আনভীরকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা ঝড় উঠে।
একপর্যায়ে দেশের ৫১ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে পুলিশের প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানান ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা আবেদন করেন নুসরাত। এরপর নতুন করে তদন্ত শুরু করে পিবিআই।
