দেনার ভার এমনই যে ক্লাবের অধিনায়ক এবং সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে সেই ঋণ মেটাতে হচ্ছে তাদের। ক্লাবটি আর কেউ নয়, শীর্ষে থাকা স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন ভ্যালেন্সিয়া। কি আশ্চর্য হচ্ছেন? এটাই সত্যি! দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ক্লাবের খেলোয়াড়দের বেতন দিতে পারছে না সাবেক স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়ন ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া।
১৯৯৯, ২০০০ সালের কথা। সে মৌসুমে বার্সেলনাকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতে ভ্যালেন্সিয়া, আর এই সে মৌসুমেই লিগ চ্যাম্পিয়ন দেপোর্তিভো লা করুনার থেকে মাত্র চার পয়েন্ট কম নিয়ে মৌসুম শেষ করে ভ্যালেন্সিয়া। সেবার বার্সেলোনার সমান পয়েন্ট নিয়েই মৌসুমের ইতি টানে তারা।
একাবিংশ শতাব্দির শুরুতে বেশ সাফল্য পেতে শুরু করে ভ্যালেন্সিয়া। আর এই সাফল্যই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেন? আসুন জেনে নেই সে কাহিনী।
বলতে গেলে একবিংশ শতাব্দিতে পাওয়া সাফল্যই তাদের শুধুমাত্র সেরা সাফল্য নয়। তাদের সেরাটা আসে ইউরোপের সর্বোচ্চ সম্মানজনক টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে। ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে উঠে যায় ভ্যালেন্সিয়া যদিও রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হেরে বসে ফাইনালে। পরের মৌসুমে ফাইনাল খেললেও শিরোপা হাতছাড়া হয় ভ্যালেন্সিয়ার। সেবার চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লিডস ইউনাইটেডকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে ভ্যালেন্সিয়া। তবে ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়েও ১-১ সমতায় শেষ হলে ম্যাচ গড়ায় টাই ব্রেকারে। আর টাই ব্রেকারে ৫-৪ ব্যবধানে হেরে হাতছাড়া হয় শিরোপা। পরের মৌসুমে আবার ব্যার্থ কিন্তু ২০০৩~০৪ মৌসুমে লা লিগার শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ভ্যালেন্সিয়া। মূলতঃ বড় ক্লাব হবার স্বপ্নটা বিভোর হয়ে বাসা বাঁধে এ জয় থেকেই।
স্বপ্নে বিভোর ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবটি শুরুতেই বড় ভুলটা করে বসে আর সেটা হলো ক্লাবের যুব একাডেমির খেলোয়াড়দের উন্নীত করার বদলে অর্থ ব্যায় করা শুরু করে দলকে ঢেলে সাজাতে। ভুলটাকে ভুলিয়ে রাখে ২০০৩~০৪ মৌসুমে উয়েফা কাপ এবং ২০০৪ সালে উয়েফা সুপার কাপও জয়, যা কিনা ক্লাবের নিতীনির্ধারকদের দলকে ঢেলে সাজাতে অর্থ ব্যায় করাতে আরও উৎসাহিত করে। শুধু জয় নয় ধারাবাহিক ভালো খেলাও খেলছিলো ক্লাবটি। কিন্তু কে জানতো এ ভালো গুলোই পরবর্তি সময়ে ক্লাবটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে??
ধীরে ধীরে ক্লাবের জৌলুস বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নেয় ভ্যালেন্সিয়া। সাফল্যকে ভবিষ্যৎ স্থায়ী করতে ক্লাবটির নজর যায় বড় প্রজেক্টের দিকে। আর পরিকল্পনাহীন এ বিলাশিতার কারনে ২০০৮ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লরেন্তে ঘোষণা দেন এই মুহূর্তে ক্লাবের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩৯ মিলিয়ন ইউরো। যার কারনে পরের বছরে স্থগিত হয়ে যায় ক্লাবের নতুন স্টেডিয়ামের কাজ, যে স্টেডিয়ামের পেছনে ক্লাবটি খরচ করে ফেলেছিলো ১৫০ মিলিয়ন ইউরো। অথনৈতিক দৈন্যতা এমনই এক পর্যায়ে যায় যে, ক্লাবের সেরা সেরা তারকাদের ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া।
জানা যায় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল এ
ছয় বছরে ক্লাবটি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইউরো লোকসান গুনেছে যা সে সময় অনেক বড় একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর ২০০৯ সালে ভ্যালেন্সিয়ার ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৪৭ মিলিয়ন ইউরোতে। যদিও ক্লাবের ক্ষেত্রে ঋণ কোনো বড় ব্যাপার না যদি ক্লাবে অর্থের প্রভাব ঠিক থাকে এবং ব্যাংককে ঋণের মুনাফা সঠিকভাবে প্রদান করা সক্ষমতা থাকে। কিন্তু ক্লাবটি ব্যাংককে মুনাফা প্রদানের অর্থই উপার্জনে ব্যর্থ হতে থাকে। ফলশ্রুতি প্রেক্ষাপটে ব্যাংকও তখন ঋণ শোধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে।
এ অবস্থায় ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়দের ধরে রাখায় বাধা আসে। রাউল আলবিওল, ডেভিড ভিয়া, ডেভিড সিলভা, হুয়ান মাতা, জর্দি আলবার মতো সম্ভবনাময় খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে বাধ্য হয় ভ্যালেন্সিয়া। সে সময় আলবিওলকে রিয়াল মাদ্রিদে, ডেভিড ভিয়াকে বার্সেলোনায়, ডেভিড সিলভাকে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে শুরু করে ভ্যালেন্সিয়া। কিন্তু খেলোয়াড়দের বিক্রি করে এত বড় ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
যতই দেনার মধ্যে পড়ুক না কেন ক্লাবকে তার খেলা পরিচালনা করে যেতে হবে অন্যথায় ক্লাব নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ঘোষনা দেন, “কারণ ক্লাবকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালো খেলোয়াড়দের বিক্রি করাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এমন এক সময় যে সময় ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ইউরোর বেতন বকেয়া ছিল এবং ক্লাবের তহবিলেও ছিল না ঠিক সে সময় এসব অবস্থার মধ্যে ২০১৪ পিটার লিম ভ্যালেন্সিয়ার সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেয়। ২০১৯~২০ সালে আবারও ক্লাব তাদের ঋণের অর্থ ফেরত দিতে শুরু করে এবং নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থও উপার্জন করে ক্লাবটি। এর পেছনে কারণ ছিল ২০১৮~১৯ মৌসুমের কোপা দেল রে’র ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে ১১ বছর পর শিরোপা উল্লাস করে ভ্যালেন্সিয়া। আর সেই সঙ্গে ক্লাবের অ্যাকাউন্টে আসতে শুরু করে অর্থ।
কিন্তু কে জানতো সবচেয়ে বড় বাঁধা অপেক্ষা করছে ক্লাবটির উঠে আসার পথ রুদ্ধ করতে। মড়ার ওপর খড়ার ঘা হিসেবে আরোপিত হয় করোনাভাইরাস। করোনার কারণে আবারও ভ্যালেন্সিয়ার অর্থ আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্লাব খেলোয়াড়দের বেতন দিয়ে অপরাগতা প্রকাশ করে, সেই সঙ্গে ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্লাবের তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় লাটো, কাঞ্জিন এবং ফাররান তোরেসের মতো খেলোয়াড়দের বিক্রি করতে বাধ্য হয় ক্লাবটি।
লা লিগায় ৯ম স্থানে থেকে ২০১৯~২০ মৌসুম শেষ করে ভ্যালেন্সিয়া। আর যে কারনে ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্টেও খেলতে পারবে না ক্লাবটি যে কারনে অর্থ আসা কমে যাবে ক্লাবটিতে। আর এ পরিস্থিতিতে ক্লাবের শেয়ারধারীরা জানিয়েছে ক্লাবের খেলোয়াড় সংখ্যা কমিয়ে খরচ কমানোর কথা।
করোনার প্রভাবে ভ্যালেন্সিয়া প্রায় ৩০ শতাংশ কম অর্থ পাবে টিভি স্বত্ব থেকে। আর সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণও কমে যাবে ৫০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ক্লাবের মোট উপার্জন কমে যাবে ৫০ শতাংশ। আর এমন পরিস্থিতিতে ক্লাবে বেশি উপার্জন করা খেলোয়াড়দের আর রাখতে পারছে না ভ্যালেন্সিয়া। সেই সঙ্গে ৩০ জনের স্কোয়াড কমিয়ে ছোট করে আনছে ক্লাবটি। কেননা সামনের মৌসুমে কেবল লা লিগায়ই লড়াই করবে তারা। আর এ কারণেই বাড়তি খেলোয়াড়দের কোনো প্রয়োজনই নেই তাদের।
এর আগে ভ্যালেন্সিয়ার অধিনায়করা এবং কিছু খেলোয়াড় ক্লাব প্রেসিডেন্ট অনিল মুর্থির সঙ্গে আলোচনায় বসে। গত জুন থেকেই বেতন ঠিকমত পাচ্ছেন না তারা। এমনটাই জানিয়েছে স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যম কাদেনা কোপ। একই রিপোর্টে আরও জানানো হয় ক্লাবের খেলোয়াড় রদ্রিগো মোরেনো, হোসে লুইস গায়া, জাউমা কস্টা মুর্থির সঙ্গে দেখা করেন। এবং তারা তাদের অখুশির কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে ক্লাবের খেলোয়াড়দের প্রস্তাব দেওয়া হয় বেতনের ব্যাপারে। এই প্রস্তাবে জানানো হয় আগামী জুন পর্যন্ত খেলোয়াড়দের বেতন প্রদানে বিলম্ব ঘটে পারে। তবে এতে করে কোনো প্রকার নিশ্চয়তা থাকছে না যে ক্লাবের খেলোয়াড়রা আদৌ বেতন পাবেন কিনা। আর এ কারণেই ক্লাবের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন খেলোয়াড়রা।
আর ক্লাবের এমন পরিস্থিতিতেই অর্থের জন্য ভ্যালেন্সিয়ার সেরা খেলোয়াড় ড্যানি পারেহো, ফ্রান্সিস কুইলেনকে ভিয়ারিয়ালের কাছে বিক্রি করেছে। এবং তরুণ প্রতিভাবান ফাররান তোরেস নাম লিখিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে। সব মিলিয়ে যেন শীর্ষ থেকে শূন্যে নেমে এসেছে স্প্যানিশ এই ক্লাবটি। এক সময় লা লিগা জয়ের জন্য জায়ান্ট ক্লাবদের বিরুদ্ধে লড়ত আর আজ তারাই ঋণের বোঝা টানতে ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে দিচ্ছে।
ঋণের বোঝায় ক্লাবের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে আগামী মৌসুমে খেলোয়াড়দের ৪০ শতাংশ বেতন কম দেওয়ার কথাও ভাবছে ক্লাবটি এবং প্রথম দলের ১২ ফুটবলারকেই বিক্রির জন্য প্রস্তুত ক্লাবটি।
বর্তমানে দলের সেরা খেলোয়াড়দের প্রতিপক্ষের ডেরায় পাঠিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নেমেছে তারা। ঠিক কীভাবে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে তারা তার নেই কোনো সঠিক সময় কিংবা সঠিক পন্থা। কেননা সবচেয়ে বড় সত্য স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে।