ছবিঃ জামালপুর শহরে পাঁচ সড়ক এলাকায় গড়ে তোলা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ চৌধুরীর আলিশান বাড়ি
অল্পদিনেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক * পদ বাণিজ্যের অভিযোগ * মানেন না দলীয় শৃঙ্খলা * স্ত্রীকে বানিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী * মেয়ের জামাই ছাত্রদলের নেতা সজীব এখন জেলা যুবলীগের সহসভাপতি
বর্তমানে জামালপুর জেলায় কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে। এরমধ্যে কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে সক্রিয় রয়েছে দুর্নীতিবাজ একটি চক্র। কৌশলে চক্রটি এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সব কাজ বাগিয়ে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করে বিল পাশ করিয়ে নিচ্ছে।
আর এর দায়ভার পড়ছে সরকারের ওপর। জানা যায়, জেলার বড় বড় প্রকল্পগুলো মাত্র দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের একটি তমা কনস্ট্রাকশন যার মালিক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। অন্যটি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকর উদ্দিন বাচ্চুর মালিকানাধীন ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন। অভিযোগ রয়েছে, এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সামনে রাখা হলেও কাজ বাগানো ও ভাগবাটোয়ার পেছনের গুরু হলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জামালপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ চৌধুরী। এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উন্নয়ন কাজে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার ও দুর্নীতি করে তিনি এখন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক।
সংশ্লিষ্ট সরকারি কয়েকটি দপ্তরে কর্মকর্তারা জানান, জামালপুর জেলার সরকারি সব সেক্টরে ফারুক আহমেদ চৌধুরীর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে তিনি সরকারি সব কাজ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তার পছন্দের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাজ করতে পারেন না। তমা কন্সট্রাকশন, চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ এবং বিএনপি মালিকানাধীন ভাওয়াল কনস্ট্রাকশনের লাইন্সেস ব্যবহার করে জেলার বড় বড় উন্নয়ন কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। এভাবেই তিনি স্বল্প সময়ে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন।
সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফারুক আহমেদ চৌধুরীর জামালপুর শহরে তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি, শ্যামগঞ্জ কালীবাড়ি এলাকায় একটি ইটভাটা, শেরপুর জেলায় শত বিঘার জমির মৎস্য খামার, মেলান্দহ উপজেলায় আটপাড়া বাজারে মার্কেট, ঝাউগড়া মসজিদের জমি জবরদখল করে এল আকৃতির মার্কেট (যেখানে রয়েছে ২৮টি দোকান), ঢাকার মনিপুরী পাড়া ও লালমাটিয়ায় ৪টি ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। জামালপুরের বিভিন্ন স্থানে তার পরিবারের সদস্যদের ও নিজের নামে শত বিঘা জমি রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রুটে ফারুক চৌধুরীর দূরপাল্লার চার ধরনের বিলাসবহুল বাস চলাচল করে।
পরিবহণ মালিকদের অভিযোগ-জেলা বাস ও ট্রাক মালিক সমিতির নামে প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা তুলে একাই পকেটে ভরেন ফারুক চৌধুরী। তিনি ওই সংগঠনের সভাপতি। গত ১৪ বছর ধরে এভাবেই চলছে।
এছাড়াও তারাকান্দি যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস সরবরাহের নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি থেকে বিক্রির জন্য বের হওয়া প্রতি বস্তা সারের বিপরীতে ৫০ পয়সা হারে চাঁদা আদায় করা হতো চৌধুরীর নামে। তার এই কাজের পার্টনার হলেন তারাকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সরিষাবাড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল আলম রফিক।
কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, হাইব্রিড ও বিরোধী মতের নেতাদের দলে এনে পদ বাণিজ্যে করে দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন ফারুক চৌধুরী। ইসলামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের আনুসারীসহ একাধিক ব্যক্তিকে জায়গা করে দিয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। ফারুক চৌধুরী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েও দলীয় মনোনয়নকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৬ সালে জামালপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন।
এছাড়া ফারুক চৌধুরী তার স্ত্রী আন্জু মনোয়ারা হেনাকে জামালপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বানিয়েছেন। হেনা টিঅ্যান্ডটি অফিসের অফিস সহকারী ছিলেন। পরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়ন পরিষদে উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান হন। হেনার বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। পরিষদে না গিয়ে ক্ষমতার দাপটে যা ইচ্ছা তাই করছেন। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন ইউনিয়নের জনগণ। অভিযোগ রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও হেনার প্রভাব রয়েছে।
শুধু তাই নয়, শেরপুরে জেলা ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমান সজীবের কাছে তৃতীয় মেয়ে তাহমিদা চৌধুরী নিশুকে বিয়ে দিয়েছেন ফারুক চৌধুরী। পরে সজীব হয়ে যান জেলা যুবলীগের সহসভাপতি। এরপর থেকে জামাই সজীব বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। অভিযোগ আছে শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে সজীব ভূমি দখল ও টেন্ডারবাজি করেন।
ছাত্র শিবির নেতা এমদাদুল হক জীবনকে পৌর আওয়ামী লীগের ১১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বিগত পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর মনোনয়ন দিয়ে কাউন্সিলর বানিয়েছেন। প্রশাসন ম্যানেজ করার নামে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জেলার প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
এছাড়া মনোনয়ন বাণিজ্যও করেছেন। ৩১ জুলাই কাউছার আহমেদ স্বাধীনকে আহ্বায়ক ও তাইফুল ইসলাম পলাশকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে জামালপুরের (মেলান্দহ উপজেলায়) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দেওয়া ওই কমিটি মনঃপূত না হওয়ায় ফারুক চৌধুরী তার সন্ত্রাসী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাঠান। সেখানে ওই বাহিনী নবনির্বাচিত আহ্বায়ক স্বাধীন, যুগ্ম আহ্বায়ক পলাশসহ তিন নেতাকে মারধর করে। প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার হুমকি দেয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক আহমদ চৌধুরী বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা। পদ বাণিজ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে টেন্ডার বাণিজ্য, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন-এসব করে আমি সম্পদের মালিক হইনি। ১৯৮০ সাল থেকে ব্যবসা করে বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছি। সূত্রঃ যুগান্তর