পুলিশ নির্যাতন করায় ধর্ষণ করে হত্যা করার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো আসামীরা। এমন দাবি করে স্বজনরা জানান, গ্রেপ্তারকৃত আব্দুল্লাহর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই শামীম। রিমান্ডের সময়ে সে ৪৭ হাজার টাকাও হাতিয়ে নেয়। মৃত জিসা মনিকে জীবিত পাওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট ২০২০ ইং তারিখে এসব অভিযোগ করেছিলেন আসামীর স্বজনরা। এ ঘটনায় তখন ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের এক কিশোরীকে ‘অপহরণ ও হত্যা’র অভিযোগে করা মামলায় আসামিকে মারধর ও ভয় দেখিয়ে পুলিশ সদস্য ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করেছে বলে বিচার বিভাগীয় তদন্তে উঠে এসেছে।
যে কিশোরী ‘অপহরণ ও হত্যা’ শিকার হয়েছিল বলে দাবি করা হয়, ঘটনার ৪৯ দিন পর সে জীবিত ফিরে আসে। তারপর শুরু হয় চাঞ্চল্য। গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
গতকাল মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারী) নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনটি বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে দাখিল করা হয়।
ওই প্রতিবেদন বলা হয়, ‘পুলিশ হেফাজতে (রিমান্ডে) থাকার সময়ে তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম আল মামুনের বিরুদ্ধে আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।’
এ ছাড়াও প্রতিবেদনের মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আইন অনুসারে আসামিদের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো অনিয়ম বিচারিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়নি।’
গতকালের শুনানির একপর্যায়ে আইনজীবী শিশির মনির ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ১৬৪ ধারায় আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের সময় অনুসরণীয় ছয় দফার একটি সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন।
ছয় দফা সুপারিশ হলোঃ
১. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিত থাকার সুযোগ দেওয়া।
২. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পূর্বে আসামিকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দেওয়া।
৩. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার সময় অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. একাধিক আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একসঙ্গে লিপিবদ্ধ না করা।
৫. সন্দেহ দূরীকরণে আসামি স্বীকারোক্তি টাইপ না করে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক স্বহস্তে লেখা উচিত।
৬. ম্যাজিস্ট্রেট যেন আইনগত সমস্ত পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য যৌক্তিক সময় পান, সে ব্যাপারে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এ বিষয়ে হাইকোর্ট শুনানি শেষ করে আগামী ১৩ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মনির। আর রাষ্ট্রপক্ষে অংশ নেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী গণধর্ষণের পর হত্যার শিকার নারায়ণগঞ্জের কিশোরীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিভিশন আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদ উদ্দিন, মো. জোবায়েদুর রহমান, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আল রেজা আমির এবং মো.মিসবাহ উদ্দিন।
সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ২৭ আগস্ট আদালত আসামিদের জবানবন্দিসহ এ ঘটনায় করা অপহরণ মামলার সব নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠাতে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে এই মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা (পরিদর্শক অপারেশন) আব্দুল হাইকে মামলার সিডিসহ ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। আর একই দিন মামলার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুনকে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার বাসিন্দা ১৫ বছরের এক কিশোরী গত বছরের ৪ জুলাই নিখোঁজ হয়। দীর্ঘদিন খোঁজ করে মেয়ের সন্ধান না পেয়ে এক মাস পর ৬ আগস্ট থানায় অপহরণ মামলা করেন তাঁর বাবা। এ ঘটনায় কিশোরীর মায়ের মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে গত ৭ ও ৮ আগস্ট পুলিশ একই এলাকার প্রেমিক আবদুল্লাহ, অটোচালক রকিব ও নৌকার মাঝি খলিল নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ তিন আসামি দুদফা রিমান্ড শেষে কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে ৯ আগস্ট আদালতে জবানবন্দি দেয়। ঘটনার প্রায় ৫০ দিন পর গত ২৩ আগস্ট মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জ এলাকা থেকে ওই কিশোরীকে জীবিত ফিরে পাওয়ার পর তার বাবা-মা বিষয়টি রাতে সদর থানায় জানায়।
স্বজনদের দাবি, তাদের মেয়ে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এবং অন্য এক যুবক ইকবাল হোসেনের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করে ভাড়া বাসায় বসবাস করেছে। আসামিদের বিরুদ্ধে এখন তাদের আর কোনো অভিযোগ নেই এবং মামলাটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানান। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। একইসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর মডেল থানার এসআই শামীম আল মামুনকে বরখাস্ত করা হয়।
