মিয়ানমারের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে সীমান্ত এলাকার মানুষের। কয়েকদিন পরপর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ শুনে আতঙ্কিত থাকে জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গারা। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার স্থানীয়রাও চরম দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে। সকাল পৌনে ৯টার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুরু হয়। থেমে থেমে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গির আজিজের। তবে হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমানার এপারে দেখা যায়নি। জাহাঙ্গির আজিজ জানান, সকাল থেকে ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ ভেসে আসছে। তুমব্রু এলাকার নুরুল আবছার বলেন, প্রচণ্ড গরমে রাতে ঘুম হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙে মিয়ানমারের গুলির শব্দে। গতকাল ১১টি ভারী গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পেয়েছি। এখনো থেমে থেমে ফায়ারিং হচ্ছে। গত এক মাস ধরে তুমব্রু সীমান্তের মিয়ানমার অংশে গোলাগুলি চলছে। ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দে কেঁপে উঠে সীমান্ত এলাকা। গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমারের ছোঁড়া দু’টি মর্টারশেল এসে পড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের তুমব্রু উত্তর পাড়ায়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর বাইশফাঁড়ি সীমান্তে আরো দু’টি মর্টারশেল পড়ে। এরপর দুই দিন বন্ধ ছিল সীমান্ত উত্তেজনা। পরে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে আবারো শুরু হয়েছে গোলাগুলি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। গুলির বিকট শব্দে কাঁপছে এপারও। তাতে আতঙ্কে কোনারপাড়ার পার্শ্ববর্তী শূন্যরেখার (নো ম্যানস ল্যান্ড) আশ্রয়শিবিরে থাকা চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা এবং ঘুমধুম ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাংলাদেশী। ওপারের গোলাগুলির ঘটনা নজরদারিতে রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
স্থানীয় মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, শূন্যরেখার দিকে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ৬২১টি পরিবারে চার হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা আছে। গোলাগুলির শব্দে তারা বেশ আতঙ্কে।
জাহাঙ্গীর আজিজ আরো বলেন, বিভিন্ন সূত্রে তিনি জানতে পেরেছেন, মিয়ানমার সীমান্তে (রাখাইন রাজ্যের তুমব্রু এলাকায়) সশস্ত্র বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে প্রায় এক মাস ধরে। সংঘর্ষে গুলির সাথে মর্টারশেলও ব্যবহার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক সোহাগ রানা বলেন, কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি হচ্ছে। মর্টার শেলসহ গুলির শব্দ কানে বাজলেও বাস্তবে সেখানে কী হচ্ছে, বলা মুশকিল। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে ওপারের গুলি ও মর্টারশেল এসে পড়েছে। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে কাঁটাতারের বাইরে পাহাড়চূড়ায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক চৌকি স্থাপন করা হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরো কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। সে সময় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া খালের দক্ষিণে শূন্যরেখায় বসতি শুরু করে। ওই আশ্রয়শিবিরের কয়েক গজ দূরে মিয়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। এই সীমান্ত এলাকায় নজরদারি করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়ন। মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির কারণ জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও ৩৪ বিজিবির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবির দেখাশোনা করে বিজিবি। সেখানকার চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে সরকারি-বেসরকারি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা হয় না।
গুলির শব্দে ঘুম হারাম : শুরুতে শূন্যরেখার এই শিবিরে ছিল এক হাজার ৩২১ পরিবারের ছয় হাজার ২২ জন রোহিঙ্গা, যাদের বাড়ি আশ্রয়শিবিরের পেছনে দেড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের রাখাইন রাজ্যের ১২টি গ্রামে। বর্তমানে শিবিরে আছে ৬২১ পরিবারের চার হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা। শূন্যরেখার কোনারপাড়া আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ (৫৫) মুঠোফোনে বলেন, ‘গুলির শব্দে ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে ক্যাম্পেই গুলি ছোড়া হচ্ছে। ’
দিল মোহাম্মদ আরো বলেন, শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দিতে ২০১৮ সালের ২ মার্চ তুমব্রু সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল মিয়ানমার। তখন প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যেত। মাইকিং করে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হতো। নইলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দেয়া হতো। বিজিবির তৎপরতায় তখন সেনা সমাবেশ সরিয়ে নেয়া হলেও একাধিক চৌকি স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘দুই মাসের জন্য আমরা এই শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে এসেছিলাম। এখন পাঁচ বছর কেটে গেল রাখাইনের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
দিল মোহাম্মদের (৫০) বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মেদি পাড়ায়। ১০ বছরের বেশি সময় তিনি বিজিপির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে চলা পতাকা বৈঠকে তিনি দোভাষীর কাজ করতেন। অথচ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা ঢলের সাথে তাঁকেও জন্মভিটা ছেড়ে সপরিবারে পালাতে হয়। সেই থেকে স্ত্রী-চার সন্তান নিয়ে তিনিও শূন্যরেখার বাসিন্দা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন চার হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গার।
সমস্যা নিয়ে বসবাস : ঘুমধুমের পাথরকাটা খালের ওপারে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির। এর পেছনে লাগোয়া মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তের উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড়ের রাস্তায় ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানদের টহলের দৃশ্য এপার থেকে দেখা যায়।
মাইবোনে বর্মী সৈন্য নিহত : এ দিকে মিয়ানমার নাও’র খবরে বলা হয়, দৃশ্যত একটি সামরিক হেলিকপ্টারকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরণে উত্তর রাখাইন রাজ্যের মাইবোন শহরে বেশ কয়েকজন মিয়ানমার জান্তা সৈন্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে হেলিকপ্টারটি শহরের সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অফিসের কাছে যাওয়ার সময় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আরাকান আর্মি (এএ) পরিচালিত এই গোলা, হেলিকপ্টারটিকে আঘাত করেনি, তবে সে সময় নিচে দায়িত্বরত বেশ কয়েকজন সৈন্যকে আরাকান আর্মি হত্যা করেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
মাইবোনের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান শহরের পশ্চিমে পাহাড়ে অবস্থানরত সৈন্যরা হামলার পর বেশ কয়েক রাউন্ড আর্টিলারি ছুড়েছে।
এক স্থানীয় যুবক বলেন, একটি বিকট শব্দ শুনে আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একজনের মতে, সেনাবাহিনীও তল্লাশি চালাচ্ছে এবং স্থানীয়দের শহর ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে।