রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অন্যান্য দেশ যখন বাংলাদেশ থেকে সরে আসার কথা তুলেছিলো তখন একমাত্র ফ্রান্সই দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছিলো। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পুরাই উল্টোদিকে দৃশ্যমান।
গত পরশু ফ্রান্সের একজন প্রভাবশালী সাংসদ ’ভিরজিনি গরন’ বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য বয়কট করার আহবান জানানোর পর আজ পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী অভিবাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানালেন ‘ফরাসি বিরোধী নেতা মেরিন লে পেন’।

ফরাসি বিরোধী নেতা ‘মেরিন লে পেন’ এর টুইট।
প্রসঙ্ত উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ফ্রান্সে প্যারিসের স্কুল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাট তাঁর “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা” পাঠদান ক্লাশে মহানবী (সাঃ) এর ব্যঙ্গ কার্টুন প্রদর্শন করাকে কেন্দ্র করে পরবর্তিতে রাশিয়ার বংশদ্ধুত এক চেচেন যুবক স্কুল শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটকে গলা কেটে হত্যা করার পরপরই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন শিক্ষক হত্যার বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যান। সাড়ে পাঁচ বছর আগে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিতর্কিত কার্টুন ছাপানোর পর ফ্রান্সের ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবদোতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। আবারও সেটি ছাপিয়েছে ম্যাগাজিনটি। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন যে, “মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করে কার্টুন ছাপানো ফ্রান্সে কখনোই বন্ধ হবে না।”
মূলতঃ প্রেসিডেন্টের এধরনের কথায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠে সমগ্র আরব বিশ্ব। ফ্রান্সের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু হয় আরব বিশ্বের অনেক দেশে ফরাসী পণ্য বর্জনের হিড়িক। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ফ্রান্স বিরোধী আন্দোলনের কার্যকলাপে বাংলাদেশের উপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ ফ্রান্স।
এ অবস্থায় ফ্রান্স নিযুক্ত বাংলাদেশ দুতাবাসের ইমেইলে হাজার হাজার স্প্যাম মেইল পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে অফলাইনে সব থেকে বেশি ফ্রান্স বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে বাংলাদেশে। এইসব নিয়ে এবার ক্ষেপেছে ফ্রান্সের সরকার এবং সেদেশের জনগণ।
উল্লেখ্য বয়কট ফ্রান্স লিখে এখন পযর্ন্ত যত কমেন্ট হয়েছে তার ৬৫ % বাংলাদেশ থেকে অন্য সব বাকি মুসলিম বিশ্বের দেশ গুলো থেকে ৩৫%।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের ইউরোপীয় ইউনিয়ন মেম্বার এবং সেদেশের সংসদ সদস্য ‘ভিরজিনি গরন’ বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন এবং যেসব মার্কেটে বাংলাদেশের প্রোডাক্ট আছে সেগুলো বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর আজ দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি মুসলিম দেশে ফ্রান্স বিরোধী বৃহত্তর বিক্ষোভচেলমান অবস্থায় ফ্রান্সে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী অভিবাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানালেন ফরাসি বিরোধী দলের নেতা “মেরিন লে পেন”।
লে পেন তাঁর টুইটার একাউন্ট থেকে টুইট করেন, “আজ বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে সহিংস বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীরা যারা আমাদের রাষ্ট্রদূতের শিরশ্ছেদ করার আহ্বান জানিয়েছিল আমি আমাদের দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় এই দেশগুলির অভিবাসনের বিষয়ে অবিলম্বে স্থগিতাদেশের আহ্বান জানাচ্ছি।” এমএলপি
তিনি আরো বলেন, “ইসলামী সন্ত্রাসের বিষয়ে আমাদের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের সাম্প্রতিক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কয়েক হাজার মুসলিম রাস্তায় নেমে আমাদের রাষ্ট্রপতি ইমমানুয়েল ম্যাক্রোঁয়ের কুশপুত্তলিকা জ্বালিয়েছেন যা ফ্রান্সকে সরাসরি অবমাননার সামিল”।
ফরাসী ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার দাবিতে প্রেসিডেন্ট তাঁর মর্যাদাপূর্ণ আহ্বানের পরে ম্যাক্রন বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বিক্ষোভের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন বলে জানান তিনি। এই মাসের শুরুর দিকে একজন শিক্ষককে নবী মুহাম্মাদের চিত্রিত কার্টুন দেখানোর জন্য এক মুসলিম যুবক দ্বারা শিরশ্ছেদ করার পরে তিনি এই কথা বলেছিলেন। ক্লাসে মোহাম্মদকে কার্টুন দেখানোর কারনে ফরাসি ইতিহাসের শিক্ষককে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করার নিন্দা করেছিলেন ম্যাক্রন।
মুসলমানরা তাদের নবীর যে কোনও চিত্রকে নিন্দনীয় বলে মনে করে। তবে শিরশ্ছেদ করার পর থেকে ফরাসী নাগরিকরা কার্টুনগুলির বিষয়ে খুন করা শিক্ষকের সাথে সংহতি জানানো শুরু করেন।
শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন বলেছিলেন যে, “প্যাটিকে ইসলামপন্থীরা হত্যা করেছে কারণ তারা ফ্রান্সের মত প্রকাশ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়, কিন্তু কার্টুন ছাপানো ফ্রান্সে কখনোই বন্ধ হবে না।”
ফ্রান্সের বিভিন্ন গনমাধ্যমে দেখানো হয় যে, গতকাল পাকিস্তানি ইসলামী মাদ্রাসার জামিয়া হাফসার এক উগ্র ইসলামপন্থী শিক্ষক মহিলা ছাত্রদের সামনে ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমমানুয়েল ম্যাক্রোঁয়ের মূর্তির শিরশ্ছেদ করেছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশু ছিলো।
এই সপ্তাহের শুরুতে বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলিম ফরাসি পণ্য বর্জন এবং ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে আন্দোলনকারীরা ঢাকার রাস্তায় নেমেছিল যা ফ্রান্সের বিভিন্ন গনমাধ্যম ফলাও করে প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত এই মার্চটিতে আনুমানিক ৪০,০০০ লোক অংশ নিয়েছিল।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এই সমাবেশে দলের কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী ও নেতা যোগ দিয়েছিলেন। এর পরে অবরোধকারীরা গুলশান কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত ফরাসী দূতাবাসের দিকে যাত্রা করে। তবে পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড লাগিয়ে তাদের বাধা দেয়।
বিক্ষোভকারীরা “ফরাসি পণ্য বর্জন” স্লোগান দেয় এবং রাষ্ট্রপতি এমমানুয়েল ম্যাক্রনকে শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। তারা বাংলাদেশে যে ইসলাম ও মোহাম্মদকে (মুসলমানরা তাদের নবী হিসাবে বিবেচিত) তাদের অবমাননাকরদের জন্য গুরুতর শাস্তির বিধানেরও আহ্বান জানিয়েছে বলে ফ্রান্সের গনমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এসব সংবাদ ও আন্দোলনের ভাষার কারনে ফ্রান্সের জনগন থেকে শুরু করে সরকার ও বিরোধীরা পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উপর বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করার দাবী জানাচ্ছে।
ফ্রান্সের জনগন ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী দলের শীর্ষ নেতাদের মন্তব্যে ক্ষুদ্ধ।
সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলনের প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান ঢাকার আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনকে শয়তানের উপাসক ও তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকেও আহ্বান জানানোর বিষয়টিও ফ্রান্সের জনগন ভালোভাবে নেয় নি বলে জানা যায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।
এই সপ্তাহের শুরুতে ইসলামাবাদে প্রায় ২ হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারীরা তাদের পথ আটকাতে চালিত কন্টেইনারগুলি একপাশে ঠেলে দিয়ে ফরাসী দূতাবাসের দিকে অগ্রসর হয়েছিল।
আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে “ফরাসি কুকুরকে বহিষ্কার করো” এবং “ফরাসীদের শিরচ্ছেদ করো” বলে স্লোগান দিয়েছিলো। পরে পাকিস্তানের নিরাপত্তারক্ষিরা আন্দোলনকারীদের পাকিস্তানে ফরাসী দূতাবাসে অভিমুখে যেতে বাধা দেয়।
রবিবার (২৫ অক্টোবর) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রনের উপর “ইসলামের উপর আক্রমণ” করার অভিযোগ এনেছিলেন।
ইমরান খান বলেন, “রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রন ইউরোপ এবং বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন মুসলমানের অনুভূতিকে আক্রমণ করেছেন এবং আঘাত করেছেন”।
এদিকে বাংলাদেশে এক শ্রেনীর চলমান আন্দোলনকারী ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের পাশপাপাশি ফ্রান্সের দূতাবাস ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও পালন করেছেন। বিষয়টি ফ্রান্সে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যে কোন কর্মসূচি দেয়ার আগে তার প্রতিফল সম্পর্কে ধারণা থাকা ও দ্বায়ীত্বশীল আচরণ করা বাঞ্চনীয়।