দীর্ঘদিনের নির্যাতন, নিপীড়ন ও দখলদারিত্বের প্রতিশোধ নিতে গত বছরের ৭ অক্টোবর সুরক্ষিত সীমান্ত পেরিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস যোদ্ধারা। এই গোষ্ঠীটি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার শাসক। ওই দিন ইসরাইলে হামাসের হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয়। পাশাপাশি ২৪০ জনের বেশি ইসরাইলী ও সেখানে পাওয়া বিদেশী নাগরিককে তুলে গাজায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা। আল-জাজিরা, প্রেসটিভি, ফার্সনিউজ, ডেইলি সাবাহ, টাইমস অব ইসরাইল, বিবিসি, আল মায়াদিন, ইরনা, প্রেসটিভি, রয়টার্স, আনাদোলু এজেন্সি, জেরুজালেম পোস্ট, আল আরাবিয়ার।
সেদিন হামাসের অতর্কিত হামলায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ। কেননা, তাদের গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে হামাস যে হামলা চালিয়েছিল তা ছিল নজিরবিহীন। হামাসের পরিকল্পনা ও কৌশলের কাছে বলা যায় অসহায় হয়ে গিয়েছিল ইসরাইলী বাহিনী। হামাসের হামলার প্রতিশোধ নিতে ৭ অক্টোবরই যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরাইল। ওই দিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা শুরু করে। ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে স্থল অভিযান। দীর্ঘ ৮৮ দিন ধরে ইসরাইলী বাহিনীর বর্বর এই আগ্রাসন চলছে। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যে গাজায় প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে আরও প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনী। চারিদিক থেকে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখায় সেখানে এরই মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে ব্যাপক সমালোচনা। ইসরাইলী বাহিনীর বর্বর এই আগ্রাসনকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও দায়ের করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এদিকে, দীর্ঘ প্রায় তিন মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে ইসরাইলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, গাজায় ১৭১ ইহুদিবাদী সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও বহু সংখ্যক। এমতাবস্থায় গাজা যুদ্ধের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে ইসরাইল। তারা সেখান থেকে কয়েক হাজার সেনাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসরাইলের যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হামাসের আটক জিম্মিদের উদ্ধার করা ও হামাসকে নির্মূল করা। মাঝে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় ১১০ জনের মতো জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বাকি জিম্মিদের কয়েকজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে ইসরাইলী বাহিনী। এর বাইরে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও কোনও জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি ইহুদিবাদী সেনারা, অথচ এটি ছিল এই যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
এই অবস্থায় যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করা নিয়ে মন্তব্য করেছে মার্কিন থিংক ট্যাংক ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ)’ এবং ‘ক্রিটিকাল থ্রেটস প্রজেক্ট (সিটিপি)।’ তাদের মতে, ইসরাইল গাজায় দীর্ঘ প্রায় তিন মাস ধরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও এই যুদ্ধে হামাসের পরাজয় কিংবা ধ্বংস কিছুই হয়নি। তারা বলেছে, ইসরাইল উত্তর গাজা থেকে পাঁচটি ব্রিগেড প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। এটিকে তারা ফিলিস্তিনি ভূখ-ে যুদ্ধের নতুন পর্যায় হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। মার্কিন-ভিত্তিক সামরিক থিংকের ট্যাংকের মতে, যুদ্ধের এই নতুন পর্যায় মানে হল- বড় ধরনের যুদ্ধ অভিযানের সমাপ্তি। সেই এই যুদ্ধ এখন থেকে “টার্গেটেড রেইড” তথা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান চালানোয় রূপান্তর করা। এর অর্থ হল- সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস সামরিক বাহিনী হিসেবে “পরাজিত কিংবা ধ্বংস কোনওটিই হয়নি”। একই সঙ্গে ইসরাইলের কৌশল পরিবর্তন “হামাসকে তার সামরিক সক্ষমতা এবং অবকাঠামো পুনর্র্নির্মাণের সুযোগ দেবে।”
আমেরিকার যুদ্ধ মূল্যায়ন বিষয়ক ওই দুই সংস্থা আরও বলেছে, হামাস যেহেতু একটি প্রচলিত সামরিক কাঠামো মেনে চলে, সুতরাং তারা যুদ্ধে নিহত কমান্ডারদের স্থলে দায়িত্বশীলদের প্রতিস্থাপন করবে। সংস্থা দুইটি আরও বলেছে, ৩১ ডিসেম্বরও গাজা থেকে তেল আবিব অভিমুখে মুহুর্মুহু রকেট নিক্ষেপ করেছে ফিলিস্তিনী যোদ্ধারা। এরপর ২ জানুয়ারিও গাজা থেকে ইসরাইলে বেশ কিছু রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ইসরাইলের দীর্ঘ সামরিক অভিযান সত্ত্বেও হামাস তার রকেট সক্ষমতা ধরে রেখেছে।
গত মঙ্গলবার লেবাননের দক্ষিণ বৈরুতে হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা সালেহ আল-আরুরিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে ইসরাইল। এ বিষয়ে মন্তব্য করে মার্কিন ওই দুই থিংক ট্যাংক ইসরাইলী গণমাধ্যমে বরাত দিয়ে বলেছে, এ ঘটনার পর ইসরাইল এখন “খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার” প্রস্তুতি নিচ্ছে।