ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার জ্বালানির উপর পশ্চিমা বিশ্ব যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা কয়েকটি দেশ ও কোম্পানি অনুসরণ করলেও কেউ কেউ ওই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ঠিকই রাশিয়ার তেল ও তেলজাতপণ্য কিনছে।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল এবং তেলজাত পণ্য ক্রয়ের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর অন্তর্ভুক্ত জাপানও গত ৮ মে রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা বা পর্যায়ক্রমে আমদানি বন্ধ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
গত ৩০ মে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সমুদ্রপথে রাশিয়ার ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) আমদানি ছয় মাসের জন্য এবং পরিশোধিত তেলজাতপণ্য আমদানি আট মাসের জন্য নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
তবে ‘দ্রাজবা’ পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ার যে অপরিশোধিত তেল পূর্ব ইউরোপ ও জার্মানির তেল শোধনাগারগুলোতে যায় তা ওই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে। পোল্যান্ড ও জার্মানি বলেছে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তারা পাইপলাইন দিয়ে আসা তেলের আমদানিও বন্ধ করে দেবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ তেল আমদানি করে তার প্রায় ৯০ শতাংশ যায় দ্রাজবা পাইপলাইন দিয়ে।
জেপি মর্গানের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একমত হওয়ার আগে ইউরোপের অন্তত ২৬টি শোধনাগার ও ট্রেডিং কোম্পানি স্বেচ্ছায় রাশিয়ার তেলের ‘স্পট পারচেজ’ স্থগিত করা এবং ধীরে ধীরে রাশিয়ার তেল আমদানি (মোট সংখ্যায় যেটা প্রতিদিন ২১ লাখ ব্যারেল) কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের রাশিয়ার তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে লাভবান হয়েছে চীন এবং ভারত। এই দেশ দুটি ইউক্রেইনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার নিন্দা জানাতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এখন তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড়মূল্যে তেল কিনছে।
‘রিফিনিটিভ একন’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে ছাড়মূল্যে তিন কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে ভারত। এছাড়া, দেশটির আগামী জুনের মধ্যে আরো দুই কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল তেল হাতে পাওয়ার কথা রয়েছে। ভারত বিশ্বের তৃতীয় তেল আমদানিকারক দেশ।
কারা রাশিয়ার তেল কিনছে আর কারা কেনা বন্ধ করেছে তা নিচে দেওয়া হল:
যারা কিনছে:
ভারত পেট্রোলিয়াম
ভারতের রাষ্ট্রায়াত্ত তেল শোধনাগার ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড মে মাসের জন্য ট্রেডার ‘ট্রাফিগুরা’র কাছ থেকে রাশিয়ার ২০ লাখ ব্যারেল ‘উরালস ক্রুড অয়েল’ কিনেছে। এ বিষয়ে অবগত আছেন এমন দুইজন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য দিয়েছেন।
ভারতের দক্ষিণের নগরী কোচিতে অবস্থিত এই তেল শোধনাগারের জন্য ভারত পেট্রোলিয়াম নিয়মিত রাশিয়ার উরালস ক্রুড অয়েল কেনে। এই শোধনাগারে প্রতিদিন তিন লাখ ১০ হাজার ব্যারেল তেল শোধন করা যায়।
হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম:
ভারতের রাষ্ট্রীয় এই তেল শোধনাগার মে মাসের জন্য রাশিয়া থেকে ২০ লাখ ব্যারেল উরালস অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) কিনেছে।
ইন্ডিয়ান অয়েল কর্প:
ভারতের শীর্ষ এই শোধনাগারটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়া থেকে ৬০ লাখ ব্যারেলের বেশি উরালস ক্রুড অয়েল কিনেছে। এছাড়া, রাশিয়ার ‘রোজনেফৎ’ কোম্পানির সঙ্গে ২০২২ সালে দেড় কোটির বেশি ব্যারেল তেল সরবরাহের বিষয়ে একটি চুক্তি করেছে।
ইতালির আইএসএবি:
ইতালির সর্ববৃহৎ শোধনাগার আইএসএবি-র মালিক রাশিয়ার বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি লুকঅয়েল নিয়ন্ত্রণাধীন সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানি লিতাস্কো এসএ। আইএসএবি রাশিয়ার ক্রুড অয়েল কেনা অব্যাহত রেখেছে। যদিও ইতালি সরকার অস্থায়ীভাবে আইএসএবি কে জাতীয়করণের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।
জার্মানির লিউনা:
চারিদিকে ভূমি ঘেরা লিউনা শোধনাগারের অবস্থান পূর্ব জার্মানিতে। যেটির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক ফ্রান্সের টোটালএনার্জিস। এই শোধনাগার দ্রাজবা পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ার ক্রুড অয়েল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
ম্যাঙ্গালুরু রিফাইনারি অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যালস:
ভারতের রাষ্ট্রপরিচালিত এই শোধনাগার মে মাসের জন্য ১০ লাখ ব্যারেল রাশিয়ার উরালস ক্রুড কিনেছে।
জার্মানির এমআইআরও:
জার্মানির বৃহৎ এই তেল শোধনাগারটির ২৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক রাশিয়ার রোজনেফৎ। তারা রাশিয়ার ক্রুড কেনা অব্যাহত রেখেছে। যেটা তাদের মোট ক্রয়ের ১৪ শতাংশ।
এছাড়াও হাঙ্গেরির এমওএল, বুলগেরিয়ার নিফতোকিম বুরগাস, জার্মানির পিসিকে সুইডৎ, ইন্দোনেশিয়ার পিটি পেরতামিনা এবং চীনের সিনোপেক রাশিয়ার ক্রুড অয়েল কিনছে। এশিয়ার সর্ববৃহৎ তেল শোধনাগার সিনোপেক রাশিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির অধিনে তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
যারা কেনা বন্ধ করেছে:
যুক্তরাজ্যর বিপি:
যুক্তরাজ্যের জ্বালানি কোম্পানি বিপি রাশিয়া থেকে সরে গেছে এবং বলেছে, ‘সরবরাহ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দেওয়া পর্যন্ত’ রাশিয়ার কারও সঙ্গে তারা নতুন কোনও চুক্তিতে যাবে না।
জাপানের ইএনইওএস:
জাপানের সর্ববৃহৎ এই শোধনাগারটি রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিকল্প যোগানদাতা খোঁজার পরিকল্পনাও করেছে।
ইএনআই:
এই জ্বালানি কোম্পানিটির ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক ইতালি সরকার। তারা রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
নরওয়ের একুইনর:
নরওয়ের এই জ্বালানি ফার্মটির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক দেশটির সরকার। তারা রাশিয়ার তেল নিয়ে সব ধরনের ব্যাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে রাশিয়া ত্যাগ করেছে।
পর্তুগালের গ্লাপ:
পর্তুগালের এই তেল ও গ্যাস কোম্পানি রাশিয়া এবং রুশ কোম্পানি থেকে সব ধরনের তেলজাত পণ্য ক্রয় স্থগিত করেছে।
গ্লোবাল ফার্ম গ্লেনকোর:
সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত গ্লোবাল মাইনিং ও ট্রেডিং ফার্ম গ্লেনকোর রাশিয়া বা রুশ মালিকানাধীন কোনও কোম্পানির সঙ্গে নতুন করে ট্রেডিং ব্যবসায করবে না বলে জানিয়েছে।
গ্রিসের হেলেনিক পেট্রোলিয়াম:
গ্রিসের সর্ববৃহৎ এই তেল শোধনাগারটি রাশিয়া থেকে ক্রুড কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। তার বদলে তারা সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশ থেকে তেল কিনছে।
ফিনল্যান্ডের নেস্টি:
ফিনল্যান্ডের এই তেল শোধনাগারটি গত এপ্রিল মাস থেকে রাশিয়ার পরিবর্তে অন্যান্য দেশ থেকে তাদের ৮৫ শতাংশ তেল কিনছে। তারা আরো বলেছে, রাশিয়ার তেল কেনার বিষয়ে তারা নতুন করে আর কোনো চুক্তি করবে না।
রোমানিয়ার ওএমভি পেতরোম:
রোমানিয়ার শীর্ষ এই তেল ও গ্যাস ফার্ম রাশিয়ার ক্রুড আমদানি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পোল্যান্ডের পিকেএন ওরলেন:
পোল্যান্ডের সর্ববৃহৎ শোধনাগারটি স্পট মার্কেট থেকে রাশিয়ার ক্রুড কেনা বন্ধ করেছে।
সুইডেনের প্রিম:
সৌদি ধনকুবের মোহাম্মদ হুসাইন আল-আমুদির মালিকানাধীন সুইডেনের সর্ববৃহৎ এই তেল শোধনাগারটি রাশিয়ার ব্যারেলের পরিবর্তে নর্থ সি ব্যারেল নিচ্ছে। যা তাদের মোট যোগানের ৭ শতাংশ।
স্পেনের রেপসল:
স্পেনের কোম্পানিটি স্পট মার্কেট থেকে রাশিয়ার ক্রুড কেনা বন্ধ করেছে।
শেল:
বিশ্বের সর্ববৃহৎ পেট্রোলিয়াম ট্রেডার শেল রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল এবং পরিশোধিত তেলজাতপণ্য কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
এছাড়াও ট্রাফিগুরা, টোটালএনার্জিস, ভেরো এনার্জি নতুন করে রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।