পাঁচ মাস আগে কাবুল বিমানবন্দরে হারিয়ে যাওয়া সাত মাস বয়সী শিশু সোহেল শনিবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে পুনরায় পরিবারের সদস্যের সাথে মিলিত হয়েছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পরে চলা অস্থিরতায় দেশে ত্যাগের আগ মুহুর্তে শিশুটি বিমানবন্দরে বাবা-মার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে কাবুল ত্যাগ করার আগে বাবা-মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া সাত মাস বয়সী আফগান শিশু সোহেলকে শনিবার ৪ জানুয়ারি তার দাদার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
উল্লেখ্যে কাবুল পতনের পরেই তার বাবা-মা জরুরি উদ্ধার অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
১৯ আগস্ট সোহেল নামে ছোট্ট শিশুটির বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। তার বাবা মির্জা আলি আহমাদি সোহেলকে কাবুল বিমানবন্দরের প্রাচীরের অপর পাশে একজন বিদেশি সৈন্যের হাতে দিয়েছিলেন।
সে সময় ছবিটি পুরো দুনিয়ায় মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
আগস্ট মাসে আফগানিস্তান থেকে পালানোর আশায় হাজার বিমানবন্দরে জড়ো হলে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
বিমানবন্দরে থাকা লক্ষাধিক মানুষের ভিড়ের মধ্যে হাত থেকে পড়ে যাওয়ার ভয়ে শিশুটির পিতা প্রচীরের অপর প্রান্তে থাকা বিদেশি সৈন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
মির্জা আলি আহমাদি সৈন্যের হাতে তুলে দেয়ার পর কয়েক মিটার দূরে তার ছেলেকে খুঁজে পাবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু শিশুটি এর পরপরই নিখোঁজ হয়ে যায়। তিন দিন ধরে সন্ধান করে না পেয়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতায় তিনি, তার স্ত্রী এবং তাদের অন্যান্য চার সন্তানসহ অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইটে উঠার সিদ্ধান্ত নেন।
কাবুল বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা তাদের বলেছিলেন, ‘‘সম্ভবত তাদের শিশু সন্তান অন্য একটি মার্কিন বিমানে আছে এবং খুঁজে পাওয়া যাবে।”
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেও সোহেলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েক মাস ধরে চেষ্টার পরেও তার বাবা-মা বের করতেছিলেন না তাদের সন্তান কোথায় কোথায় আছেন।
সাত সপ্তাহে সমঝোতা
মূলত আগস্ট মাসের চলা বিশৃশৃঙ্খল অবস্থায় শিশু সোহেলকে হামিদ সাফির নামে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার উদ্ধার করে তার পরিবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। হামিদ সাফির জানান, উদ্ধারের আগে তিনি শিশুটিকে কাবুল বিমানন্দরের এক পাশে একটি মেঝেতে কান্নারত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছিলেন।
নভেম্বরের শেষ দিকে রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে হামিদ সাফি বলেন, “আমি সেই সময় ভেবেছিলেন যদি তার পরিবারকে খুঁজে পাই তবে সোহেলকে আমি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেব। অন্যথায়, আমি নিজেই শিশুটিকে বড় করব।”
হামিদ সাফি জানান, বিমানবন্দরের ভেতরে শিশুটির পরিবারকে খোঁজার কোন চেষ্টা করা হয়নি। তিন কন্যা সন্তানের বাবা হামিদ একটি ছেলে সন্তানের স্বপ্ন দেখছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে সোহেলকে পেয়ে তিনি নিজের সন্তানের মতো মানুষ করতে শুরু করেন। সোহেলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ আবেদ।
শিশুটির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে নভেম্বর মাসে গণমাধ্যমে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হলে হামিদফ সাফির প্রতিবেশীরা শিশুটির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গণমাধ্যমকে জানান।
এ তথ্য জানতে পেরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিশুটির পিতা মির্জা আলি আহমাদি আফগানিস্তানে থাকা তার আত্নীয়দের হামিদ সাফির কাছে পাঠান। এমনকি তারা শিশুটিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন উপঢৌকন দেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে হামদ সাফি শিশুটিকে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তালেবান পুলিশের হস্তক্ষেপে শিশুটিকে আফগানিস্তানে থাকা তার দাদার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সাত সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে। এক পর্যায়ে তালেবান পুলিশ হামিদ সাফিকে সাময়িকভাবে আটক করলে অবশেষে শিশুটিকে তার দাদার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
শিশুটি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা পরিবারের কাছে স্থানান্তরের অপেক্ষায় আছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা খুব দ্রুত এই পরিবাররের পুনর্মিলন নিশ্চিত করতে কাজ করছি।”
“আমি এক রাতে ঘুমাইনি, আমি খুব খুশি”
শিশুটির বাবা-মা এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে অবস্থান করছেন। তারা ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের সন্তানের দাদার কাছে বুঝিয়ে দেয়ার মুহুর্তটি দেখেছেন৷
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে সোহেলের মা সুরায়া জানান, “আমি খুব কষ্টে ছিলাম। আমার বাচ্চার কথা ভেবে সারাক্ষণ কেঁদেছিলাম। এখন সে এখানে নিরাপদে আছে। গতরাতে আমার ঘুম আসেনি, আমি খুব খুশি ছিলাম।”
এই ঘটনায় মুলত কাবুল বিমান বন্দরের সেই দুঃসহ দিনগুলির চিত্র তুলে উঠে এসেছে। গত গ্রীষ্মে বিশৃঙ্খল উদ্ধার অভিযানের সময় অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আফগানিস্তানের আমেরিকান দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য ছাড়া প্রায়শই পারিবারিক পুনর্মিলনের বিষয়ে উত্তর পাওয়া অসম্ভব বলে মনে করেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত আফগান শরণার্থীরা।
সোহেল এবং তার বাবা-মায়ের মধ্যে পুনর্মিলনের তারিখ এখনও জানা যায়নি। পরিবার পুনর্মিলনের বিষয়টির সাথে পরিচিত এক আমেরিকান প্রতিনিধি বলেছেন, লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার পরে নতুন করে আর কোনো বিমান আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে না। একই সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন সরকার বর্তমানে কাতারের পাশাপাশি আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে এই পরিস্থিতির সমাধানের জন্য আলোচনা করছে।