অর্থনীতির নানা সংকটের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য নিজের চতুর্থ বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি এবার পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেটের নাম দিয়েছেন কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন। এবারের বাজেটের ফলে বেশ কিছু পণ্যের দাম উঠানামা করবে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক আরোপ করায় দাম বাড়ছে সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাকজাত পণ্যের। এছাড়া দাম বাড়বে আমদানি করা মোবাইল, ফ্রিজ, বিলাসবহুল গাড়ি, লাপটপ, প্রিন্টার ও প্রিন্টিং টোনারের।দাম বাড়ার তালিকায় আরো রয়েছে আমদানি করা পানির ফিল্টার, লিফটসহ বিভিন্ন পণ্য। শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করায় এসব পণ্য কিনতে ক্রেতাকে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। বাজেটে শুল্ক বৃদ্ধিতে দাম বাড়বে কাগজ, বেকারি শিল্পের সুগন্ধি, কফি, সৌর প্যানেলের। এদিকে শৌখিন পশু পাখি, অপটিক্যাল ফাইবার আমদানিতে শুল্ক বেড়েছে।এছাড়া আমদানি করা পনির ও দইয়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিদেশি পনির ও দইয়ের দাম বাড়তে পারে।
সিগারেটের নিম্ন স্তরের দশ শলাকার দাম ৩৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫৭ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম বাড়তে পারে।আমদানি করা তৈরি পোশাকে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিদেশি পোশাকের দাম বাড়বে।
দাম বাড়বে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, অপরিশোধিত আলকাতরা, বিদেশি পাখি, প্রিন্টিং প্লেট, ক্যাশ রেজিস্ট্রার, ফ্যান, মোটর, লাইটার, দুই স্ট্রোক ও ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিনের সিএনজি, কম্পিউটার প্রিন্টার ও টোনার, আমদানি করা মোবাইল চার্জার, কার্বন ডাই-অক্সাইড, আমদানি করা পেপার কাপ এবং প্লেটের।
এ ছাড়া বিলাসবহুল গাড়ি, রিকন্ডিশন ও হাইব্রিড গাড়িতে ২০০০ সিসি থেকে ৪০০০ সিসিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে এসবেরও দাম বাড়বে।
দাম কমছে শ্রবণ যন্ত্র, হুইল চেয়ার, ধান কাটার মেশিন ও কৃষি যন্ত্রপাতির। এছাড়া কোল্ড স্টোরেজ ও শিল্প খাতের শীতলকরণ যন্ত্রে শুল্ক কমেছে। এসি ও ননএসি রেস্টুরেন্টে ভ্যাট কমায় খরচ কমবে ভোক্তার।এছাড়া স্বর্ণ আমদানিতে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে স্বর্ণালঙ্কারের দাম কমতে পারে।শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের শ্রবণ সহায়ক যন্ত্রের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে শ্রবণ সহায়ক যন্ত্রের দাম কমতে পারে।হুইল চেয়ারে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ অগ্রিম কর থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে হুইল চেয়ারের দাম কমতে পারে।
এ ছাড়া শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে পানির ফিল্টার, বিমানের জন্য ব্যবহৃত টায়ার, কাজু বাদাম ও পেস্তা বাদামে।ফলে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে।
করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কমছে বড় ও অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ। ফাস্ট ট্র্যাকের আট প্রকল্পে সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে সরকার খরচ করবে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বৃহস্পতিবার (০৯ জুন) সংসদে দেয়া অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনা অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ায় বরাদ্দ কমেছে অগ্রাধিকার প্রকল্পে।
প্রতি অর্থবছরের বাজেটেই সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বড় অংশজুড়ে থাকে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন আর বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনা। কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি সামলাতে বহু কাটছাট করতে হয়েছে সরকারের নীতি পরিকল্পনায়। যদিও এর মধ্যেও অব্যাহত ছিল ফাস্ট ট্র্যাকের আট মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন।কিন্তু আসছে অর্থবছরের বাজেটে বড় প্রকল্পে বরাদ্দ কমাতে যাচ্ছে সরকার। ১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা কমিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেয়া হচ্ছে ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা কমিয়ে মেট্রোরেলে থাকছে ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলেও সেতুর রেলপথ অংশে বরাদ্দ থাকছে ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা। আর ২৫০ কোটি টাকা কমিয়ে পায়রা বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে দেয়া হচ্ছে ২৮৬ কোটি টাকা।
সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মনে করেন, এই মুহূর্তে কোভিড পরবর্তী ধাক্কা সামলানোই বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়নের কারণেও কমছে বড় প্রকল্পের বরাদ্দ।তবে বিশ্ব অর্থনীতির মতো দেশেও চলমান সংকট মোকাবিলায় অহেতুক ব্যয় বন্ধের সঙ্গে অর্থ সাশ্রয়ের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
অর্থনীতিবিদ ড. হেলালউদ্দিন বলেন, বড় বড় প্রকল্পে যদি আমরা আরও সাশ্রয়ী হতে পারতাম, তবে সঞ্চয় করতে পারতাম। এতে একই অঙ্কের টাকা দিয়ে আরও প্রকল্প হাতে নেয়া যেত।যদিও নতুন বাজেটে এডিপিভুক্ত সাত প্রকল্পের মধ্যে পাঁচটির বরাদ্দ কমলেও ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের বরাদ্দ আর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পে বেড়েছে ৫১৭ কোটি টাকা। বেড়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বরাদ্দও। আসছে অর্থবছরে ঘুমধুম রেলপথে দেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, আর মাতারবাড়িতে সরকার খরচ করবে ৬ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।