সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক মাসের মধ্যে দ্বিতীবারের মতো পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য সার্কুলার জারি করেছে৷ আর এই সার্কুলার দেশের সকল ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে৷ তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাইরে যেকোনো রূপে গচ্ছিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত এনে শতকরা সাত ভাগ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই সার্কুলারটি বিজ্ঞপ্তি আকারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য বলেছে৷এই সার্কুলারটি গত ১৮ জুলাই প্রথমবার সব ব্যাংকে পাঠানো হয়েছিলো৷যাতে বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায় সে জন্য দ্বিতীয়বার সার্কুলারটি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম জানিয়েছেন, বাজেট পাশ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া কোনো অর্থ ফেরত আসেনি৷ তিনি রোববার এনবিআরের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘বিদেশ থেকে শুধু বৈধ টাকা ফেরত আনলে কর সুবিধা পাওয়া যাবে।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কালো টাকার কথা বলছি না৷ অপ্রদর্শিত আয়ের কথা বলছি৷ নানা কারণে এ ধরনের অলস পড়ে থাকা অর্থ দেশে আনতে পারছেন না অনেকে৷”
পাচার ও রেমিট্যান্স নিয়ে বিভ্রান্তি:
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের যেকোনো উপায়ে গচ্ছিত এবং শুধু অপ্রদর্শিত আয় শব্দ দুইটি নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে দুই ধরনের বক্তব্য তো কনফিউশন সৃষ্টি করবে৷”
আরো এক ধরনের বিভ্রান্তির কথা বলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম৷ তার মতে, সরকারে এই সিদ্ধান্তে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে৷আগে তো বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সে কোনো কর ধার্য করা হতো না৷আবার পাচার করা টাকা ফেরত আনলে শতকরা সাত ভাগ কর দিয়ে বৈধ করা যাবে৷ এখানে বৈধ না অবৈধ তা নির্ধারণ করা হবে কীভাবে৷ এখন যারা বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠান তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন৷সেটা হলে কিন্তু সামনে বিপদ হতে পারে৷রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে।”
সরকার মরিয়া:
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকার এখন বেশ চাপে আছে৷ রিজার্ভ কমে যাচ্ছে যাচ্ছে৷ রেমিট্যান্সও কমে যাচ্ছে৷ রপ্তানি বাড়ছে, তবে সেরকম বাড়ছে না৷ তাই সরকার অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠছে বাইরে থেকে রেমিট্যান্স আনতে৷ পাচার করা টাকা ফেরত আনতে৷”
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এতে খুব একটা কাজ হবে না৷ যারা টাকা পাচার করেন তারা দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য করেন না৷ আর পাচারের টাকা ফেরত আনলে যিনি আনবেন তিনি ট্র্যাকিং-এ পড়ে যাবেন৷ এর আগেও আন্ডার আর ওভার ইনভয়েসিং-এর অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা হয়েছে তাতে কাজ হয়নি৷ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েও কাজ হয়নি৷ আর এখন দেশের অবস্থাও তেমন ভাল না৷টাকা দেশে আনলে সেটা নিরাপদ হবে কী না তাও যারা পাচার করেছেন তারা ভাববেন৷”
অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘পাচার করা টাকা ও বিদেশে বৈধভাবে উপার্জন করা টাকার মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করা হবে তা নির্ধারণ করা জরুরি৷ এই বিভ্রান্তি দূর না হলে সরকার যে বিদেশ থেকে যেকোনো উপায়ে এখন ডলার আনার উদ্যোগ নিয়েছে তার উল্টো ফল হতে পারে৷”
সাধারণ ক্ষমা:
অর্থমন্ত্রী আ ন হ মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলে জানিয়ে বলেন, ‘‘বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ফেরত আনলে শতকরা ১৫ ভাগ কর দিতে হবে৷ অস্থাবর সম্পত্তি ফেরত আনলে ১০ ভাগ কর৷ আর রেমিট্যান্স আকারে ফেরত আনলে সাত শতাংশ কর দিতে হবে৷ এই সুযোগ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে৷”
অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণায় বৈধ অবৈধ অর্থের কোনো পার্থক্য করা হয়নি৷
পাচারের হিসাব নেই:
বাংলাদেশ থেকে কত টাকা পর্যন্ত পাচার হয়েছে তার হিসাব সরবারের কাছে নেই৷ তবে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা এখনকার বিনিময় হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে৷আর সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে সেখানে বাংলাদেশিদের টাকা জমা আছে প্রায় পাঁচ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার থেকে মোট আট লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
আইন বহাল আছে:
পাচার করা অর্থ ফেরত আনায় সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দেয়া হলেও দেশে অর্থ পাচার বিরোধী আইনটিও কার্যকর রয়েছে।
২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং বা মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে তিনি কমপক্ষে চার বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১২ বছরর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷আইনের ১৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা মানি লন্ডারিং অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দেশে বা দেশের বাইরে যে কোনো সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিতে পারবেন৷”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব মিলিয়ে বিভ্রান্তি এবং অস্পষ্টতা জটিলতার সৃষ্টি করছে৷
এই সব ইস্যু নিয়ে চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের কোনোর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি৷
নিউজ DW।