টানা তিন ঘন্টার বৃষ্টিতে গতকাল সোমবার সিলেট মহানগরীর অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে গিয়েছিলো। পানিবদ্ধতা পিছু ছাড়ছে না সিলেটবাসীর। বৃষ্টির মৌসুমে এরকম দৃশ্যপটই নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই মৌসুমে পানিবদ্ধতার যন্ত্রণায় নিত্য ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও পানিবদ্ধতা থেকে কেন মুক্তি মিলছে না, ওঠছে সেই প্রশ্নও।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার টানা তিন ঘন্টার ভারি বৃষ্টিতে পানিমগ্ন হয় সিলেট। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। নগরবাসীকে পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ক্লাসরুমে পানি ঢুকে যাওয়ায় ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে ১০৮.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টির পানিতে তৈরি হয় পানিবদ্ধতা।
আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী দৈনিক সংগ্রামকে জানান, ‘তিন ঘন্টার টানা বৃষ্টিপাতে ১০৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কম সময়ের মধ্যে এটা অনেক বেশি পরিমাণ বৃষ্টি। যার ফলে নগরীতে দ্রুত পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারি বৃষ্টির ফলে নগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, রাজারগলি, উপশহর, যতরপুর, ছড়ারপাড়, ভাতালিয়া, জল্লারপাড়, তালতলা, চৌহাট্টা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, শিবগঞ্জ, নয়াবাজার, খাসদবির, মেডিকেল রোড, মজুমদারি, দক্ষিণ সুরমার লাউয়াইস্থ বঙ্গবীর রোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যায়। অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটুপানি জমে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়িতে। অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ে পানি। বিশেষ করে নিচু এলাকায় বসবাসরত মানুষের দুর্ভোগ ছিল বেশি। শুধু পানি ঢুকে পড়াই নয়, ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানি অনেকের বাসা-বাড়িতে ঢুকেছে।
নগরীর ছড়ারপাড়ের বাসিন্দা ঝিলু মিয়া বলেন, ‘পানিবদ্ধতার কষ্টের কথা বলে লাভ নাই। আমরা থাকি বাসার নিচতলায়। বৃষ্টি হলেই আমরা আতঙ্কে থাকি, এই বুঝি বাসায় ঢুকে পড়লো পানি! আজও ঘরে ঢুকেছে পানি। জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করতে করতে আমরা হয়রান।’
সড়ক পানিমগ্ন হয়ে পড়ায় চলাচলেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় নগরবাসীকে। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন শিবগঞ্জের আবির ফয়সাল। কিন্তু জলমগ্ন সড়কে যানবাহন না পেয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি বাসায় ফিরে যান।
এদিকে, তিন ঘন্টার বৃষ্টিতে পানি ওসমানী মেডিকেল কলেজের নিচতলায়ও ঢুকে পড়ে। নগরবাসী বলছেন, পানিবদ্ধতার পেছনে শুধু ভারি বৃষ্টিই দায়ী নয়, এর পেছনে সিটি করপোরেশনের কর্তাদেরও দায় আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরও নগরীতে যখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তখন সংশ্লিষ্ট কাজে গাফিলতি আছে বলে মনে করছেন নগরবাসী। এ ছাড়া ছড়া-খাল, নালা-নর্দমা নিয়মমাফিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না বলেও নগরবাসীর অভিযোগ।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।
সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে পানিবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে পানিবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে পানিবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।
২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পানিবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
এই প্রকল্পের আওতায় দুই অর্থবছরে সিসিক ৩২৯ কোটি টাকা পেয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির আওতায় অন্যান্য কাজের সাথে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে প্রকল্পটির সিংহভাগ বরাদ্দ ব্যয় হওয়ার কথা।
এবারের বৃষ্টির মৌসুমে বেশ কয়েকবার পানিমগ্ন হয়েছে সিলেট নগরী। গত জুলাই মাসেও পানিবদ্ধতার কবলে পড়েন নগরবাসী। তখনও ১২২৮ কোটি টাকা কোথায় গেল, সেই প্রশ্ন ওঠে জোরেশোরে।
সমালোচনার প্রেক্ষিতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নে ১২২৮ কোটি টাকা শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই পরিমাণ অর্থ পেতে বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি করপোরেশনকে নিজস্ব আয় থেকে ২০ শতাংশ অর্থাৎ ২৪৫ কোটি যুক্ত করতে হবে। ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৮২ কোটি টাকা সরকার দেবে। বরাদ্দের পুরো টাকা চারটি অর্থ বছরে ছাড় দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই বরাদ্দের প্রথম ধাপে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১২৯ কোটি টাকা পায় সিসিক। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দুইশ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এখন পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে সিসিক পেয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা।’ বরাদ্দকৃত টাকা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ, তা ‘সঠিক নয়’ বলেও দাবি করছেন মেয়র আরিফ, ‘সরকারি অর্থ কারো পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হয়ে খরচ করা অসম্ভব। নজরদারির জন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে।’