২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে ২০১১ থেকে কাতারে নতুন নতুন স্টেডিয়াম, নতুন বিমানবন্দর, হোটেল, আধুনিক গণপরিবহনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়নযজ্ঞ চলছে। আর এসব প্রকল্পগুলোতে কমপক্ষে ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছেন।
কাতারে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান৷
বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রস্তুতির কর্মকান্ডের কাজে সম্পৃক্ত ১০১৮ জন বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক ১০ বছরে কাতারে প্রাণ হারিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশ- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলংকার মোট ৬৭৫১ জন অভিবাসী শ্রমিক ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাতারে প্রাণ হারিয়েছেন বলে ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান মঙ্গলবার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তথ্য প্রকাশ করেছে। গার্ডিয়ান বলছে, প্রাণহানীর মধ্যে ভারতের ২৭১১ জন, নেপাল ১৬৪১, পাকিস্তান ৮২৪ এবং শ্রীলংকার ৫৫৭ জনও রয়েছেন। যদিও এর সঙ্গে ফিলিপিন্স ও কেনিয়া থেকে কাতারে পাঠানো বিপুল সংখ্যক মারা যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা যোগ করা হয়নি৷
আরও পড়ুনঃ কর্ম সূত্রে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাত্রা।
গার্ডিয়ান জানায়, বিভিন্ন দেশের সরকারি উৎসগুলো থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে৷ ২০১০ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করে কাতার৷ আর তখন থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার এই পাঁচ দেশের গড়ে ১২ জন করে শ্রমিক প্রতি সপ্তাহে মারা গেছে৷ পত্রিকাটি জানায়, মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এছাড়া প্রাণহানীর তালিকায় অন্যান্য দেশের শ্রমিকরাও রয়েছে।
গত ১০ বছরে কাতার প্রধানত ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে অবিশ্বাস্য নির্মাণ কর্মসূচি শুরু করেছে৷ নতুন সাতটি স্টেডিয়ামের পাশাপাশি বহু বড় প্রজেক্টের নির্মাণ ইতোমধ্যেই শেষ করা অথবা হওয়ার পথে৷ নতুন বিমানবন্দর, সড়ক, গণপরিবহন ব্যবস্থা, হোটেল ও নতুন শহর, সবই বিশ্বকাপের অতিথিদের জন্য জন্য তৈরি করা হয়েছে৷
উপসাগরীয় দেশগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফেয়ারস্কয়ার প্রজেক্টের পরিচালক নিক ম্যাকগিহান জানান, “মৃত্যুর রেকর্ডগুলো পেশা ও কাজের স্থান অনুযায়ী তালিকাবদ্ধ করা না হলেও যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেই বিশ্বকাপের অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে কাজ করতেন, এটি ধরে নেওয়া যায়৷ বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়৷ আয়োজক কমিটির মতে ৩৪ জনের মৃত্যু ‘কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কারণে’ হয়নি৷ এর মধ্যে এমন বেশ কয়েকজন শ্রমিক স্টেডিয়াম নির্মাণস্থলেই সংজ্ঞা হারিয়ে মারা গেছেন৷ এসব তথ্য ২০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষায় কাতার যে ব্যর্থ হয়েছে সেটিই তুলে ধরছে৷ মূলত তরুণ শ্রমিকদের এই উচ্চ মৃত্যুর কারণ তদন্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে কাতার৷”
মৃত্যুর পরিসংখ্যানের পেছনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু পরিবারের কাহিনী আছে যারা তাদের পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়েছেন৷ এসব পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আর অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর পরিস্থিতি নিয়েও বিভ্রান্ত৷ বাংলাদেশি শ্রমিক মোহাম্মদ শহীদ মিয়া শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানে খোলা বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে আসা মেঝেতে জমে থাকা পানি থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান৷ ভারতের মধু বোল্লাপাল্লির পরিবার বুঝেই উঠতে পারছেন না কীভাবে ৪৩ বছর বয়সী স্বাস্থ্যবান লোকটি কাতারে কাজ করার সময় ‘স্বাভাবিক কারণে’ মারা গেল৷
কাতারের নির্মম মৃত্যুর এসব সংখ্যা দাপ্তরিক স্প্রেডশিটের লম্বা তালিকায় কারও নামের পাশে মৃত্যুর কারণ হিসেবে উপর থেকে পড়ে একাধিক ভোঁতা আঘাত, ফাঁসিতে ঝুলে থাকার কারণে শ্বাসকষ্টে মৃত্যু বা কারও মৃতদেহ পচন ধরায় কারণ নির্ণয় করা যায়নি বলে লেখা আছে৷ তবে সবচেয়ে বেশি আছে তথাকথিত ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’; যেখানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ অথবা শ্বাসতন্ত্র বিকল হওয়াকে দায়ী করা হয়েছে৷
গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয়, নেপালি ও বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৬৯ শতাংশের মৃত্যুর স্বাভাবিক কারণে হয়েছে৷ গার্ডিয়ানের আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, শ্রেণিবদ্ধকরণ প্রায়ই কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই করা হয়েছে৷
গার্ডিয়ান জানায়, ২০১৯ সালে গ্রীষ্মকালে কাতারের তীব্র গরম সম্ভবত বহু শ্রমিকের মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য একটি কারণ৷ গার্ডিয়ানের পাওয়া তথ্যকে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনুমোদিত একটি গবেষণাও সমর্থন করেছে৷
কাতার কর্তৃপক্ষ এসব প্রাণহানীর ঘটনাকে ’স্বাভাবিক মৃত্যু’ বললেও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তা কোনক্রমেই মানতে নারাজ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মৃত্যুর ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে কর্তৃপক্ষীয় সচ্ছতা ও জবাবদিহীতার প্রকট অভাব রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, শ্রমিক মৃত্যুর মত এতোবড় জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কাতার অবজ্ঞা করছে। কাতারভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মৃত্যুর যে রেকর্ড কাতারে রাখা হয় তাতে পেশা এবং ঘটনাস্থলের কোন উল্লেখ থাকে না।
এদিকে, কাতারে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মৃত্যুর ব্যাপারে ঢাকা এখনো কোন মন্তব্য করেনি।
