ঢাকামঙ্গলবার , ৭ জুন ২০২২
  1. অনান্য
  2. অপরাধ ও আইন
  3. অভিবাসীদের নির্মম জীবন
  4. অর্থনীতি
  5. আত্মসাৎ
  6. আন্তর্জাতিক
  7. ইতিহাস
  8. উদ্যোক্তা
  9. এশিয়া
  10. কৃষি
  11. ক্যাম্পাস
  12. খেলাধুলা
  13. গণমাধ্যম
  14. গল্প ক‌বিতা
  15. চট্টগ্রাম বিভাগ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

“বাজেট বুঝি না “এমন একটা বাজেট হোক যেখানে গরিব মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ৭, ২০২২ ১০:৫৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে আরেকটি বড় বাজেট উত্থাপন করতে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত অতটা খারাপ মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে। চাল-ডালের দাম বাড়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। বিগত কয়েক মাস ধরে সারা দেশে নিত্যপ্র্যোজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলছে।

বাজেট নিয়ে ঢাকার এক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ।বাজেট নিয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলে, কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন তিনি। সহজ ভাষায় জিজ্ঞাসা করা হলে, এক কথায় জবাব দেন, ‘পেটের দায়ে রিকশা নিয়া নামছি। বাজারের যে হাল তাতে কামাই দিয়া কুলায় না। বাজেট বুঝি না, চাল-ডালের দাম কমলেই খুশি আমরা।’
বর্তমানে চিকন দানার মসুর ডালের কেজি ১৪০ টাকা, মোটা দানা ১১০ টাকা। পাইজাম চালের কেজি ৫৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল কেজিপ্রতি ১৮৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা কেজিতে, দেশি রসুন ১০০ টাকা, আদার কেজি ১২০ টাকা, হলুদ-মরিচের গুঁড়ার কেজি ২০০-২৩৫ টাকা। বাজারদর দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছে প্রতি বেলায় ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতেও গুনতে হবে বড় অঙ্কের টাকা।

নিম্নবিত্ত মানুষেরা বাজেট এবং মূল্যস্ফীতির কাটখোট্টা টার্ম না বুঝলেও একটা জিনিস তারা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছেন-বাজারের দামের সঙ্গে তাদের জীবিকার মান এখন ব্যস্তানুপাতিক ।এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে বড় অঙ্কের এ বাজেটের অর্থের সিংহভাগ সামাজিক সুরক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উৎপাদনশীল নানা খাতে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধিতে খরচ করা হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেটের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া।

মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে একটি বাস্তবিক উদহারণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক- মূল্যস্ফীতি নিম্নবিত্তদের জীবিকায় আঘাত করে, মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ের পথ বন্ধ করে ও উচ্চবিত্তদের মনে বিরক্তির উদ্রেক করে।বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যেই সমাজের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে চা বিক্রি করেন মোতালেব হোসেন। ছয় জনের পরিবার তার। তিনি জানান, আগে চা বিক্রি করেই খেয়ে-দেয়ে সংসার চলে যেত। কিন্তু এখন খাবারে টান পড়ছে, বাজারে দাম বেড়েছে, বাড়িওয়ালা বাড়িয়েছে বাড়ি ভাড়া, ব্যবসাক্ষেত্রে বেড়েছে সরবরাহ ব্যয় ও পরিবহন ভাড়া। কিন্তু তিনি চাইলেও চা কিংবা সিগারেটের দাম বাড়াতে পারছেন না। বাড়তি দামে কেউ চা-সিগারেট কিনছে না। এতে করে তার আয় না বাড়লেও বেড়েছে ব্যয়ের হিসাব।
বাজেট থেকে তিনি কী চান এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, ‘এমন একটা বাজেট হোক যেখানে গরিব মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। চিনি ও চা-পাতার দাম কমানো দরকার।’প্রণোদনার কথা উঠতেই ভাজাপোড়া বিক্রেতা সাইদুল বলেন, ‘কই প্রণোদনা! কিছুইতো পাইলাম না। কীভাবে পেতে হয় তাও জানি না। কার কাছে ঋণ চাইতে হয় তাইতো জানি না। পুরা করোনার সময়ে বইসা থাকলাম। এখন ব্যবসা শুরু করলেও বাজারের যে অবস্থা তাতে মনে হয় না রাজধানী শহরে ব্যবসা চালায়ে টিকা থাকতে পারব।’সমাজের নিম্নবিত্ত এ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এটা বেশ স্পষ্ট যে, তাদের কাছে প্রণোদনা কিংবা ঋণের ব্যাপারগুলো স্পষ্ট না। সমাজের আসল সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার পরও সুবিধাভোগী হতে পারছেন না তারা। এক্ষেত্রে বাজেটে ঋণ ও প্রণোদোনার অর্থ বণ্টন আরও স্বচ্ছ ও সহজ উপায়ে যাতে হয় সেদিকেই জোর দেন তারা।

বিজয়সরণী ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলেই এক ঝাঁক শিশু হাতে রঙ-বেরঙের গোলাপ নিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তাদেরই একজন সুমাইতা। বয়স দশ বছরের বেশি না। সরকারের দেয়া অর্থ বরাদ্দ থেকে সে কী চায় জানতে চাইলে স্বভাবসুলভ হাসিমুখে জানায়, আগে মানুষ অনেক ফুল কিনত। একদিনে ৫০০ টাকার ফুল বিক্রি হতো। এখন বিক্রি নেমে এসেছে ২০০-৩০০ টাকায়। কিন্তু বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে। কোনোভাবেই কুলানো যাচ্ছে না। ‘আমি চাই সরকার জিনিসপত্রের দাম কমায়ে দিক।’
সুমাইতার একটা কথা ছিল খুবই তীর্যক, ‘মানুষ এখন আর ফুল কেনে না।’ মানুষ কেন ফুল কেনে না জানতে চাইলাম ব্যাংক কর্মকর্তা মঈনুল হাসানের কাছে। তিনি সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়তি। আমার বেতন অর্ধলাখের কাছাকাছি। আগে সারা মাসের খরচ শেষেও ১০-১৫ হাজার টাকা বেচে যেত। সেখান থেকে কিছু টাকা যেত সঞ্চয়ে, কিছু টাকা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘোরাঘুরি, কেনাকাটায়। আগে প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার আগে স্ত্রী-পুত্রদের জন্য কিছু একটা কিনে নিয়ে যেতাম; সেটা হোক ফুল কিংবা খেলনা। কিন্তু গত মাসে হিসাব করে দেখলাম খেয়েদেয়ে, বাসা-ভাড়া দিয়েও আমাকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। ফুল কিনবো কোথা থেকে?’

বাজেট নিয়ে সরকারের কাছ থেকে কী আশা করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মঈনুল হাসান বলেন, ‘আমি মনে করি সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই- বিশ্ববাজার অস্থির এখন। এক্ষেত্রে বিলাসবহুল দ্রব্যের ওপরে বাড়তি কর চাপিয়ে, নিত্যপণ্যে ভর্তুকি দেয়া উচিত।’

ভর্তুকি প্রশ্নে কথা ওঠে ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি কার্যক্রম নিয়ে। হুমায়ুন রশীদ একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদে কাজ করেন। অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘শুরুর দিকে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে লজ্জা লাগত। পরে লজ্জার মাথা খেয়ে পেটের দায়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কয়দিন পরে টিসিবি কার্ড সিস্টেম করল। আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তরা কোনো কার্ড পায়নি। যেটুকু সুবিধা পাচ্ছিলাম, তাও এখন আর পাচ্ছি না। না খেয়ে আছি এমন না। তবে মাসের শেষে এক টাকাও সঞ্চয়ের জন্য থাকছে না। মাঝেমধ্যে মাসের শেষে সহকর্মীদের থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে।’

মানুষের কথা শুনে খাতা-কলমে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়- বাজারে মূল্যস্ফীতির দশা এতটা শোচনীয় কী না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে। তবে বেসরকারি জরিপ বলছে অন্য কথা। সানেম কিংবা সিপিডির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, দেশের মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১১ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) করা একটি জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে একজন মানুষের মাসিক খাবারের ব্যয় ৫ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এ খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। যদি কোনো পরিবার পুরো মাসে একবারও মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি না খায়, তাহলেও খরচ ৮ হাজার ১০৬ টাকা। পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যয় ৪৭ হাজার ১৮২ টাকা। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে চলতি বছরে কেবল খাবারের ব্যয়ই বেড়েছে ১১ শতাংশ।

এক্ষেত্রে সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরের মানুষের একটাই আশা- বাজেটে সরকার যেন সামাজিক সুরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ নজর দেয়। এ ব্যাপারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিতে জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি রাখতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর সাময়িক সময়ের জন্য তুলে দেওয়া প্রয়োজন। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রায় একই কথা বলেন বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেটে অভ্যন্তরীণ শিল্প, কৃষি এবং রফতানিমুখী সব কটি খাতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গুরুত্ব পাওয়া উচিত বলে মনে করি। এর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যে কৌশল নির্ধারণে জোর দেবে সেটি আমি মনে করি সময়োপযোগীই হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেটের আর্থিক বিবরণীর সারসংক্ষেপ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় মোট খরচ করা হবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এটা পুরো বাজেটের ১৬ দশমিক ৭০ ভাগ, আর জিডিপির ২ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের তুলনায় এই ব্যয় ৫ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা।

এ ছাড়াও ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ব্যয় হবে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে ভর্তুকি খাতে ৪২ হাজার ৪৫ কোটি, প্রণোদনা বাবদ ৩০ হাজার ৭০০ কোটি এবং নগদ ঋণ বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ব্যয় করা হবে ১৯ হাজার কোটি টাকা। বছরজুড়ে ব্যাপকভাবে খাদ্য-বান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস, ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখা) মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি আয়ের সংস্থানে এই অর্থ ব্যয় করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, বাজেটের এই বরাদ্দের অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে সংকট অনেকটাই প্রশমিত হবে। এতে করে দেশে স্বাভাবিক নিয়মেই উৎপাদন, সেবা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, আয় ও দক্ষতা বাড়বে। ফলে কমে আসবে মূল্যস্ফীতি, বাড়বে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল অপরাজিতবাংলা ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন oporajitobangla24@yahoo.com ঠিকানায়।