ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার কয়েকটি সীমানা এলাকা দিয়ে অবৈধপথে প্রতিদিন প্রবেশ করছে হাজার হাজার বস্তা চিনি। বিশেষ করে রমযানকে সামনে রেখে চিনি পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে শতগুণে। এসব পাচারের সঙ্গে দেশের কয়েকটি নামীদামি কোম্পানি জড়িয়ে পড়েছে। তারা পাচারকারীদের কাছ থেকে সস্তায় চিনি সংগ্রহ করে তা নিজেদের ব্রা-ের বস্তায় ভর্তি করে প্রায় দ্বি-গুণ দামে বিক্রি করে।
গত রোববার সারাদিন নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সীমানা এলাকায় ঘুরে এমনসব তথ্যই পাওয়া গেছে। সরেজমিনে সীমান্ত এলাকা ঘুরে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, পাচারকৃত চিনি মজুত করার জন্য সীমানার কাছে গড়ে তোলা হয়েছে গোডাউন। সীমানা দিয়ে আসা এসব চিনি একত্রিত করার জন্য এসব গোডাউন ব্যবহার করা হয়। কলমাকান্দার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এসব গোডাউনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সময়ে এসে সীমানার কাছের অধিবাসীরা কেবল চিনি পাচার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মজার কথা হলো সস্তা দামে এসব চিনি কিনে আনা হলেও সীমানা পার হয়ে গোডাউনে প্রবেশ করে বস্তা বদল হয়ে ব্রা-ের চিনি হয়ে যায়। সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব হারালেও স্থানীয় প্রশাসন নিরব ভূমিকায় রয়েছে।
শনিবার রাতে নেত্রকোনার বিরিসিরি এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বাসে বসেই পরিচয় হয় দুর্গাপুর এলাকার ব্যবসায়ী শাকিলের সঙ্গে। সাংবাদিকতা করি কথাটা জেনেই দুর্গাপুর যাওয়ার অনুরোধ করে বলেন, সীমানা দিয়ে প্রতিদিন আসছে হাজার হাজার বস্তা চিনি। এসব চিনি অবৈধভাবে আনার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করছে দেশের নামাী দামী কয়েকটি কোম্পানি। বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গেলেও উদ্দেশ্য বাক নেয়। চলে যাই দুর্গাপুরে। শনিবার সারারাত এবং রোববার সারাদিন ঘুরে যা জানা ও দেখা গেল তা রীতিমত পিলে চমকে ওঠার মতো অবস্থা। সীমানা দিয়ে দেদারসে অবৈধভাবে হাজার হাজার বস্তা চিনি এলেও স্থানীয় প্রশাসন কিছুই বলছে না। জেলার সংবাদ কর্মীরাও কিছু বলছে না। পরে জানা গেল যারা কথা বলবেন তাদের মিডিয়ার মালিকদের কোম্পানিগুলোই এই চিনি পাচারের সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয় একজন সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে রাতের বেলায় বিজয়পুর থেকে শুরু করে দুর্গাপুর এলাকার কয়েকটি স্থানে যান এই প্রতিবেদক। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো– মেঘালয় সীমান্তের পাঁচগাও,বিজয়পুর, ভবানীপুর, কালাপানি, লেঙ্গুড়া, কচুগড়া, পাতলাবন, সন্যাসীপাড়া মহেশকোলা সীমান্ত দিয়ে দেদারসে ভারতীয় চিনির বস্তা মাথায় করে প্রবেশ করে মানুষ। সুমেশ^রী নদী পার হয়ে দেশে আসে বিক্ষিপ্তভাবে। পরে সীমান্তবর্তী গোডাউনে আসে। সেখানে তারা সাদা বস্তা থেকে ব্রা-ের বস্তায় ঢুকানো হয়। সেখান থেকে ব্রা-ের বস্তায় করে ট্রাকে ভরে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ফ্রেশ, তীর এবং ইগলু কোম্পানীর গোডাউনের সন্ধান পাওয়া যায়।
স্থানীয়রা জানান, সীমান্তের কচুগড়া ও পাতলাবন এলাকা দিয়ে দেশে হাজার হাজার চিনির বস্তা প্রবেশ করে। এসব চিনি কলমাকান্দার এতিমখানা রোডের একটি গোডাউনে এসে ঢুকে সেখান থেকে বস্তা বদল হয়ে দেশীয় ব্রান্ডের একটি কোম্পানীর বস্তায় ভরা হয়। সেখান থেকে ট্রাকযোগে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। রাস্তার দুইপাশে রয়েছে আরও অনেকগুলো গোডাউন। এসব গোডাউনে এসে স্থান পায় ভারত থেকে পাচার করা চিনি। সেখান থেকে কেবল বস্তা বদল হয়ে প্রায় দ্বি-গুণ দামে বিক্রি হয় দেশের অন্যান্য স্থানে গিয়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলমাকান্দা এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, ভারত থেকে সীমানা পার করা পর্যন্ত ৫০ কেজি এক বস্তা চিনির দাম পড়ে ৩ হাজার ৭শ’ টাকা। এরপর আরও দুটি হাত বদল হয়ে চলে যায় কোম্পানীর লোকজনের হাতে। এই এক বস্তা চিনি দেশীয় বাজারে বিক্রি হয় ৬ হাজার ২শ’ টাকা।
প্রসঙ্গত সীমানা পার হওয়ার বিভিন্ন কায়দায় নিয়ে এসে গোডাউনে বস্তা বদল করার ভিডিও এই প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত রয়েছে। ফ্রেশ কোম্পানীর নেত্রকোনা জেলার প্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা আশিস আলাপকালে জানান, তাদের ফ্যাক্টরি নারায়ণগঞ্জে। সীমানায় চিনি পাচারের সাথে তাদের কোন যোগসাজশ নাই। তবে এব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কোন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।