প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবজাতির কল্যাণে যুদ্ধ ও
অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের জন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি তাঁর
আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে গাজার একটি হাসপাতালে
সাম্প্রতিক হামলায় নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা গতকাল গাজার হাসপাতালে বোমা
হামলা চালিয়ে মানুষ ও শিশুদের হত্যা এবং শিশুদের রক্তমাখা মুখ দেখেছি।
আমি বিশ্ব নেতাদের আহ্বান জানাচ্ছি-যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে।’
শেখ হাসিনা আরো বলেন, যুদ্ধ এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা
কখনই মানবজাতির জন্য ধ্বংসের পরিবর্তে কল্যাণ
বয়ে আনতে পারে না।
যুদ্ধে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অস্ত্র প্রতিযোগিতার অর্থ সারাবিশ্বের শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা হোক।
সরকার প্রধান আজ সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের
৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২৩’
এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিজয়ীদের মধ্যে ‘শেখ রাসেল
পদক-২০২৩’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ পদক-২০২৩’
বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে একথা বলেন।
বিজয়ীদের মাঝে ‘শেখ রাসেল পদক ও স্মার্ট বাংলাদেশ পদক’ প্রদান করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল
জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ এবং সরকারের তথ্য ও
যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ যৌথভাবে এই
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের
ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন,
আজকে সারা বিশ্বে যে যুদ্ধ চলছে,
ফিলিস্তিনে নারী-শিশু মারা যাচ্ছে, ইসরাইলেও মারা গেছে।
গতকাল দেখলাম হাসপাতালে বোমা হামলা করা হয়েছে।
সেখানে মানুষ মারা গেছে, শিশু মারা গেছে,
দেখলাম রক্তাক্ত সেই শিশুদের চেহারা।
তিনি বলেন, আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বলবো-যুদ্ধ বন্ধ করুন।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন।
যুদ্ধ আর অস্ত্র মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে না।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় শিশু আর নারীরা।
আর যুবকরা দেয় জীবন। সন্তান হারান পিতা-মাতা।
পিতা-মাতা হারান সন্তান। তাদের যে কি বেদনা সেটা আমরা জানি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি
যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন, কিভাবে রাস্তায় রাস্তায়
মানুষের লাশ পড়ে রয়েছে।
আর ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে
হত্যার পর প্রবাসে রিফিউজি জীবন কাটাতে বাধ্য হতে হয়েছে তাঁকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ এর আমরা দুই বোন এবং আমাদের পরিজনরা জানে এই কষ্টটা কি।
আমাদেরতো রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছে।
সেতো আরো কষ্ট।
নিজের নাম পরিচয়টা দিতে পারবো না, অন্যের দেশ,
ভাষা আলাদা। সেখানে থাকতে হয়েছে কবে ফিরবো
দেশে একটা অনিশ্চয়তা-সেভাবেই তো ছ’টি বছর কাটাতে হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।
শান্তি সমৃদ্ধি বয়ে আনে, আর যুদ্ধ কেবল ধ্বংস করে।
সেজন্য আমি যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, এই অস্ত্র বানানোর এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায়
যে অর্থ ব্যয় হয় সেই অর্থ সারাবিশ্বের শিশুদের খাদ্য,
স্বাস্থ্য এবং তাদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হোক।
সেটাই আমাদের দাবি, আমরা তা-ই চাই। আমরা সবসময় শান্তির পক্ষেই কাজ করি।
প্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন,
আমার ছোট্ট রাসেল সোনার মত, আর যেন কাউকে
এভাবে জীবন দিতে না হয়।
একটা ফুল না ফুটতেই যেন ঝরে না পড়ে।
সেটাই আমার কামনা। কবি সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতার
কয়েকটি পংক্তি তুলে ধরে এ সময় বিশ্বকে নবজাতকের
বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন তিনি।
সরকার প্রধান অনুষ্ঠানে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্ত বিভাগ বাস্তবায়িত সারাদেশের একগুচ্ছ প্রকল্পের
উদ্বোধন ও বেশকিছু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
বাংলাদেশ পুলিশ সরকারি ক্যাটাগরিতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’
পদক লাভ করায় মহা পুলিশ পরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ
আল মামুন প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক গ্রহণ করেন।
একই ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ঢাকা,
পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও জেলা এই পদক লাভ করায়
সংশ্লিষ্ট জেলাপ্রশাসকগণও প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে
পদক গ্রহণ করেন।
একই সাথে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২৩’
উপলক্ষে মাসব্যাপী ক্রীড়া, চিত্রাংকন ও সাংস্কৃতিক
প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পরপরই শেখ রাসেলকে নিয়ে একটি থিম সঙ পরিবেশিত হয়।
আর শেখ রাসেলসহ ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের শহিদদের
রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন তথ্য ও যোগাযোগ
প্রযুক্তি সচিব মো. শামসুল আরেফিন, আয়োজক
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. চৌধুরী নাফিস শরাফত,
সাংগঠনিক সচিব ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতন এবং
শিশু বক্তা সামিরা নাইর চৌধুরী।
শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মহাসচিব কে এম শহীদুল্লাহ স্বাগত বক্তৃতা করেন।
ভারতের সাবেক সেনাকর্মকর্তা কর্নেল অশোক কুমার তারা’র একটি ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়।
তিনি ’৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পরিবারকে পাকিস্তানি
বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার পর রাসেলকে যেমন
দেখেছেন তা নিয়ে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ
পলক সম্পাদিত শেখ রাসেলের জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ
‘স্মরণের আবরনে শেখ রাসেল’এর মোড়ক উন্মোচন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা গ্রন্থ
‘আমাদের রাসেল সোনা’কে নিয়ে নির্মিত ত্রি-মাত্রিক
চলচ্চিত্র ‘আমাদের রাসেল সোনা’র ট্রেলার প্রদর্শন করা হয়।
শেখ রাসেল দিবস ২০২৩ উপলক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ
বিভাগ নির্মিত তথ্যচিত্র ও প্রদর্শিত হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট
ছেলে শহীদ শেখ রাসেলের ৬০তম জন্মদিন আজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল ১৯৬৪
সালের এই দিনে স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন।
শিশু রাসেলের জীবন সম্পর্কে শিশু-কিশোরদের কাছে
তুলে ধরতে তার জন্মদিনকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারে রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয়বারের মতো ‘শেখ রাসেল দিবস-২০২৩’ পালনের প্রতিপাদ্য ‘শেখ রাসেল দীপ্তিময়, নির্ভীক নির্মল দুর্জয়’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের
নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পায়নি শিশু শেখ রাসেল।
বঙ্গবন্ধুর সাথে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করে।
রাসেল তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
শিশুদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ তোমরা যারা শিশু এখানে আছো, বাবা-মার কথা শুনবে।
ঠিকমতো লেখাপড়া করবে।
লেখাপড়া ছাড়া মানুষ বড় হতে পারে না।
আমাদের ছেলেদেয়েদের মধ্যে এই আকাংখা থাকবে, আমরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবো।
বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো।
তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়ন
চায় এজন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে উল্লেখ
করে তিনি বলেন, আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ
আমাদের টার্গেট।
আর আমাদের আজকের এই শিশুরাই আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের দক্ষ সৈনিক হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার গঠন করার পর থেকে
আমার প্রচেষ্টা ছিল বাংলাদেশকে আর্থসামাজিকভাবে
উন্নত করা। ছোট্ট শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল করে দেয়া,
বই দেয়া এবং খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।
এসবের মধ্যদিয়ে শিশুদের গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছি।
ছোটবেলা থেকে যেন খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার অভ্যাস হয়, সে ব্যবস্থা করেছি।
৭১ সালের বন্দিজীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর আমরা তখনো বন্দী।
‘রুদ্ধ দ্বার, মুক্ত প্রাণ’। একবার চেষ্টা করেছে ভেতরে এসে আমাদের ওপর হামলা করতে।
একটা ছোট্ট তার আমাদের বাঁচিয়ে দেয়।
একটা কাপড় ঝোলানো তারের সঙ্গে লেগে সে অফিসার পড়ে যায়, পরে সে ফিরে যায়।
পরে কর্নেল অশোক তারা এসে ১৭ ডিসেম্বর আমাদের মুক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বন্দিখানা থেকে রাসেল সেনাদের প্যারেড দেখেছে।
গ্রামের বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে সে প্যারেড করতো।
বাচ্চাদের পুরস্কারও দিতো।
তার জীবনের বড় স্বপ্ন ছিল- সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি।
তিনি বলেন, পচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বাবা-মা,
ভাই সবাইকে হত্যার পর সব শেষে রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
তখন আমার ছোট বোন শেখ রেহানা আর আমি বিদেশে ছিলাম। ছয়টি বছর দেশে আসতে পারিনি।
আর আমাদের এই হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকারও ছিল না।
জিয়া ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে খুনীদের বিচারেরর পথ রুদ্ধ করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদ
১৯৮৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।
সে সময় দেশে স্বৈরশাসন চলছিল।
ছেলে-মেয়েদের খেলাধূলা, সঙ্গীত চর্চা বা সেধরনের কোন উন্মুক্ত পরিবেশই তখন ছিলনা।
ইতিহাস বিকৃতি চলছিল। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের
এবং বিজয়ের ইতিহাস, এত আত্মত্যাগ এত রক্তদানের
ইতিহাস আমাদের শিশুরা সে সময় জানতেই পারেনি।
শিশুদের সে সময় স্বাধীন দেশের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আজ এই সংগঠনের অনেক শিশু দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, শিশুদের সুপ্ত মেধা এবং মননকে বিকষিত
করা।
তাদের ভেতরে মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং দায়িত্ব
ও কর্তব্যবোধ গড়ে তোলা, সেই সাথে সাথে ধর্ম বর্ণ
নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান, সেই চোখ নিয়ে দেখার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।
প্রতিবন্ধিদের সমানভাবে দেখতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে স্থান করে দিতে হবে।
এভাবেই মানুষের জন্য মানুষ হিসেবেই নিজেদেরকে
গড়ে তোলার জন্যও শিশুদের প্রতি আহবান জানান তিনি।