আশির দশকের আগ থেকে মহানন্দা নদীতে শ্রমিকদের পুর্বপুরুষদের ন্যায় পাথর সংগ্রহ করলেও পাথরের কোন কমতি নেই। সেই সময় মহানন্দা নদীতে পাহাড়ি পানির ঢলের খর স্রোত খুব বেশি ছিল। কিন্তু পাথর শ্রমিকের সংখ্যা খুব কম ছিল। তখন শ্রমিকেরা মহানন্দা নদীতে ৫/৬টি কলাগাছের ভেলা তৈরি ঢাঁকি কোঁদাল আর নেট নিয়ে সাঁতরিয়ে নদীর বালুচর ঘেঁষে পাথর সংগ্রহ করত। প্রায় ঘন্টা চারেক পর উক্ত ভেলায় ৮/১০টি ঢাঁকি বোঝাই পাথর নিয়ে ঘাটে ফিরে আসত। আবশ্য এসময় নদীর পানি আর খরস্রোত বেশি হওয়ায় অনেক সময় পানির স্রোতে ভেলা উল্টে সব কিছু ভেসে শ্রমিকদের সর্বনাশ হত। আর এমন অবস্থায় পড়লে শ্রমিকদের সেই দিনে রুটিরুজি বন্ধ হয়ে যেতো। পুনরায় নুতন করে পাথর তোলার সামগ্রী কিনে নদীতে যেতে হতো। মহানন্দা একটি আন্তঃ সীমান্ত নদী হওয়া সত্ত্বেও নব্বই দশকের পর ভারতের ফুলবাড়ি নামক স্থানে একতরফা বাঁধ নির্মাণ করে মহানন্দা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তন করে। ফলে মহানন্দা নদীর খোরস্রোত যেনো ভাটা পড়ে। নদীর বুকে জেগে উঠে ধূধূ বালুর চর। তখন থেকে মহানন্দায় পাথর শ্রমিকদের ভেলা ভাসার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে ভারতের বিএসএফ পাথর তোলার বাঁধা দেয় এবং বিএসএফ’র বাঁধা অপেক্ষা করে জীবনের ঝুকি নিয়ে নদীতে পাথর তুলতে গিয়ে ঝাড়ুয়াপড়া, সন্ন্যাসীপাড়া ও দক্ষিণ-উত্তর কাশিমগঞ্জ গ্রামের বেশ ক’জন পাথর শ্রমিক বিএসএফ’র গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান। তখন মাঝে মধ্যে মহানন্দা নদীতে পাথর তোলা বন্ধ থাকত। এনিয়ে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী পতাকা বৈঠক করে বিরোধ নিস্পত্তি করত এবং মহানন্দা নদীতে পাথর তোলা ব্যবস্থা করত। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে ভারত সীমান্তে কাটা তাঁরের বেড়া নির্মাণ করার পরও পাথর শ্রমিকদের উপর সীমান্তবাহিনীর নির্যাতন চালাত। বর্তমানে মহানন্দা নদীতে বর্ষাকালের গাড়ীর টিউব পানিতে ভাসিয়ে এবং শুস্ক মৌসূমে শ্রমিকেরা দু’টি ঢাঁকির ভার সাঁজিয়ে বালুর চর বেয়ে পাথর সংগ্রহ করে। বর্তমানেও পাথর সংগ্রহে এই ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
সর্দারপাড়া গ্রামের পাথর শ্রমিক জাহাংগীর, বারঘরিয়া গ্রামের আশরাফুল এবং সাহেবজোত গ্রামের হবিবর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, মহানন্দা নদীর পাথর তোলে আমাদের পুর্বপুরুষেরা জীবন জীবিকা নির্বাহ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। আমরাও এই নদীতে পাথর তোলে পরিবার পরিজন নিয়ে যুগের পর যুগ পাথর তুলে আসছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনার ফাঁকে নদীতে পাথর তোলার কাজ করেন। বর্তমানে এ উপজেলার বাসিন্দারা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকার গরীব দুঃখী লোকজন এই এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে নদীতে পাথর তোলার কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করে আসছে। শ্রমিকরা জানায় ভারতের বিএসএফ’ এখন পাথর তোলতে বাঁধা দেয় না। বরং তাদের অফিসার আসলে বলে হিন্দি ভাষায় বলে ‘‘গিল্টি তোলা মদ কর-ওপারে ভাঁগ যাও’’ আমরা তখন নিরাপদে চলে আসি। তাদের অফিসার চলে গেলে পুনরায় পাথর সংগ্রহ করি।
শ্রমিকরা জানায়, মহানন্দা নদীর কনকনে ঠান্ডা পানিতে পাথর তোলার কারণে তাদের শরীরে চর্ম রোগ, এলার্জি, বাতব্যথা ইত্যাদি রোগ হয়। বাজারে পল্লী চিকিৎসকদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হয়ে পুনরায় নদীতে কাজ করে। এভাবে তাদের জীবন ও জীবিকা মহানন্দা নদীর পাথর তোলে যুগযুগ ধরে চলে আসছে।
পাথর ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, একজন শ্রমিক দিনে ৫/৬ ঘন্টা পাথর সংগ্রহ করে ৮শ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে। শ্রমিকদের কাছে প্রতি ঘনফুট (এক সেফটি) পাথর বর্তমানে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে কেনা হয়। আমরা নেটিং, ছাটাই-বাছাই ও শুটিং করে প্রতি সেফটি পাথর ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করি। তবে শ্রমিক ছাড়াও ট্রাক মালিক,চালক,ব্যবসায়ী পাথরের উপর নির্ভও করে জীবন জীবিকা চালিয়ে বেকারত্ব জীবন থেকে রেহাই পেয়েছি। এ পাথর উত্তোলন করতে না পারলে এ এলাকায় ভীষন দূর্ভিক্ষের কবলে পড়তো ও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে পড়তো এলাকার মানুষ।