আবার পিছিয়ে গেল বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। চলতি বছরই দরপত্র আহ্বানের কথা থাকলেও আপাতত তা হচ্ছে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দরপত্র ডাকা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এক্সন মোবিলসহ আগ্রহী আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা বন্ধ রয়েছে। নির্বাচনের পর এ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর প্রায় ৯ বছর কেটে গেলেও সাগরে বাংলাদেশের তেল-গ্যাসসহ প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়টি অজানাই থেকে গেছে। দীর্ঘ ছয় বছর ঝুলে থাকার পর সম্প্রতি মাল্টিক্লায়েন্ট জরিপ শেষ হয়েছে। এখন চলছে ডেটা বিশ্লেষণ। গত ২৬ জুলাই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল পিএসসি (উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি) অনুমোদন দেয় সরকার। এবারের পিএসসিতে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির (আইওসি) জন্য বেশ আকর্ষণীয় সুযোগ রাখা হয়। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের কথা জানিয়েছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে।
গত ৮ নভেম্বর এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে এলএনজি আমদানি-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, নির্বাচনের পরে নতুন সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র আহ্বান করবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস ও কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধান কাজ সমাপ্ত না করেই চলে গেছে। এর মধ্যে একাধিকবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইওসিগুলোর কাছ থেকে তেমন সাড়া মেলেনি। তাদের পরামর্শ অনুসারে একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে পিএসসি পর্যালোচনার কাজে নিয়োগ দেয় পেট্রোবাংলা। সেই
কোম্পানির সুপারিশ অনুসারে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে মডেল পিএসসিতে সংশোধন আনা হয়। গত জুলাই মাসে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সংশোধিত পিএসসি অনুমোদন করে।
২০১৯ সালের মডেল পিএসসি অনুযায়ী, অগভীর ও গভীর সমুদ্রের প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৫.৬ ও ৭.২৫ ডলার। সংশোধিত পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ড ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান, অর্থাৎ বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ক্রুড) দাম ১০০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ১০ ডলার। বর্তমান পিএসসি অনুসারে, অগভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাসে বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং গভীর সমুদ্রে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ। সংশোধিত পিএসসির খসড়ায় বাংলাদেশের হিস্যা অগভীর সমুদ্রে ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ এবং গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পাশাপাশি গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়েছে।
পিএসসি অনুমোদনের পর সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, চলতি বছরই আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে পরিকল্পনা পাল্টে গেছে। নির্বাচনের কারণে এ বছর দরপত্র ডাকা হচ্ছে না। তাই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চলতি বছর শুরু হচ্ছে না।
বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গত মার্চে প্রথমবারের মতো আগ্রহ প্রকাশ করে এক্সন মোবিল। সে সময় তারা গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লক ইজার চেয়েছিল। গত ১৬ জুলাই আরেকটি চিঠি দেয় মার্কিন কোম্পানিটি। এতে বলা হয়, এক্সন প্রথমে গভীর সমুদ্রে ৪ থেকে ৫ কোটি ডলার ব্যয়ে দ্বিমাত্রিক জরিপ করবে। ফল ইতিবাচক হলে ৫ থেকে ১০ কোটি ডলার খরচ করে ত্রিমাত্রিক জরিপ করবে। কূপ খননে গড়ে ৮ থেকে ১০ কোটি ডলার খরচের কথা জানিয়েছে এক্সন। কোম্পানিটি বলছে, তাদের পরিকল্পনা অনুসারে গ্যাস মিললে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমে যাবে, এতে বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে বাংলাদেশের। এক্সনের প্রস্তাব নিয়ে বেশ আগ্রহী হয় সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র-সংক্রান্ত লবিকে কাজে লাগাতে সরকার এক্সনের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সে সময় বলেছিলেন, এক্সনের প্রস্তাবকে সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তারা এক্সনের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখবে।
কিন্তু এর পর বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি। পেট্রোবাংলার একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে এক্সনের প্রস্তাব নিয়ে আর আলোচনা না করার বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহল থেকে নির্দেশনা এসেছে।
এক্সনের সঙ্গে চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সমকালকে বলেন, আলোচনা চলবে। তবে নির্বাচনের পর এগুলো চূড়ান্ত হবে।
বঙ্গোপসাগরকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক আছে ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক আছে ১৫টি। বর্তমানে শুধু ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে কাজ করছে।
