ক্রমান্বয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাটহাজারি মাদ্রাসার চলমান আন্দোলন প্রেক্ষাপট। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আহমদ শফী এবং বাবুনগরীর গ্রুপের উত্তেজনা যে কোনো সময় মোড় নিতে পারে রক্তপাত সংঘর্ষে। হাটহাজারী এলাকায় উভয় গ্রুপ বৃদ্ধি করছে নিজেদের শক্তি।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষাসচিব আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়ার পর এবং পরবর্তিতে আরোপিত শর্ত যথাযথভাবে প্রতিপালিত না হওয়ায় হাটহাজারী মাদ্রাসা পুনরায় ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। আজ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে আদেশ জারি করা হয়েছে।
কিন্তু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সরকারের এ আদেশ জারি প্রত্যাখ্যান করেছে। আজ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মসজিদের মাইকে এ আদেশ প্রত্যাখানের ঘোষণা দিয়েছে। এতে সার্বিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে আকার ধারন করে।
আন্দেলনকারীরা বলেন, “আমাদের মাদ্রাসা সরকারি নয়। তাই এই মাদ্রাসা বন্ধের সরকারী সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। মাদ্রাসার শুরার সদস্যরা বৈঠকে মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে আমরা তা মেনে নিব।” তারা আরও বলে, “অন্যথায় আন্দোলনের দাবানল জ্বলে ওঠবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে।” এদিকে সন্ধ্যার পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাদ্রাসার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শুরা সদস্যদের নিয়ে বৈঠক এখনও চলছে।
কিন্তু কেন এ হঠাৎ আন্দোলন? এ আন্দোলনের পিছনে কাদের ইন্দন থাকতে পারে? ~ ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরে দৈনিক অপরাজিত বাংলার অনুসন্ধ্যানী চোখে উঠে আসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
নেপথ্যে দু’জন ব্যাক্তি :একজন হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী ও অপরজন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
ঘটনার নেপথ্য ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবি নিয়ে হেফাজতে ইসলাম গঠন করার পর বছর দুয়েক না যেতেই আমির ও মহাসচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায় উভয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ছিলো মুখ্য।
গত ১৭ জুন জুনায়েদ বাবুনগরীকে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয় মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শেখ আহমেদকে। এ ছাড়া বাবুনগরীর ভাগিনা মাদ্রাসার শিক্ষক আনোয়ার শাহকে মাদ্রাসা থেকে এক মাস আগে বের করে দেওয়া হয়। আনাসের একছত্র আধিপত্যে বাবুনগরীর সমর্থনপুষ্ঠ শিক্ষকদের অব্যহতি দিয়ে নিজের মনমতো শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া, সবকিছু মিলিয়ে বাবুনগরীর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হন আনাসের ওপর। যার বহিঃপ্রকাশ আজকের আন্দোলন।
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী অনুসারীরা বলছেন, “মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী শুরু থেকেই সরকারকে বেকাদায় ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।” তারা বলেন ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে তারিখে ঢাকার শাপলা চত্বরে আহমদ শফীর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাবুনগরী তার গোপন সমর্থন পুষ্ঠ বিএনপি ও জামাতের সাথে গোপন আঁতাত করে সরকার নামানোর চেষ্টা করেছিলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতর আহমদ শফি ও শফি পুত্র মাওলানা আনাস সাহেবের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের নিয়ে গ্রুপিং সৃষ্টি করেছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাবুনগরীকে অব্যহতি দেওয়া হয় তাঁর দায়িত্ব থেকে।”
আপরদিকে বাবুনগরীর অনুসারীরা বলছেন, “২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনায় আহমদ শফি ও তাঁর ছেলে আনাস বর্তমান সরকারের সাথে আঁতাত করে সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা খেয়ে পুরা হেফজতে ইসলামের সাথে বেঈমানী করেছে। শফি পুত্র মাদ্রাসায় পুরানো অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সরিয়ে অর্থের বিনিময়ে তার পছন্দ মতো শিক্ষকদের নিয়োগ দিতো। মাদ্রাসার ফান্ডের বিপুল পরিমান অর্থ তছরুপ করেছেন এই মাওলানা আনাস। বাবুনগরীর অনুসারীরা আরও জানান যে, মাওলানা আনাস এই বলে হুমকি দেয় যে, বেশী ঝামেলা করলে বাবুনগরী আর তার পান্ডাদের সন্ত্রাস আর অস্ত্র মামলায় ভিতরে ঢুকিয়ে দিবে কারন সরকার ও প্রশাসন নাকি ওদের হাতে।
কিন্তু বিশ্লেষকরা ঘটনার অনুসন্ধ্যানে বলছেন আরও গভীরের কিছু কথা।
তাঁদের মতে, হেফাজতে ইসলামীর জন্ম হয়েছিলো গণজাগরণকে ট্যাকেল দিতে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ক্ষমতা দেখাতে গণআদালতের সময়ও জামাতশিবির একই টাইপের বাহিনী নামিয়ে ছিলো। তখন বিএনপির আমল ছিলো বলে তাদের বেশী শোডাউন দিতে হয় নাই। সেই তান্ডবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪জন নেতানেত্রী দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত হইছেন, গোলাম আজম নাগরিকত্ব পেয়েছেন। কিন্তু, ২০১৩ সালে তা ঘটে নি। কারন শাপলা চত্বর থেকে তাদের ফেরত পাঠিয়ে ছিলো সরকার। ব্যালেন্স করতে শাহবাগও খালি করে দিয়েছিলো।
বিশ্লেষকদের মতে, হেফাজত আসলে একটি ফোর্স। অস্বীকার করার উপায় নাই। গরীব এতিম মাদ্রাসার বাচ্চাদের যাবার কোনো জায়গা নেই। আপাতদৃষ্টে ভবিষ্যতও নেই। বড় হুজুরের হুকুমে ধর্ম বাঁচাতে এরা জীবন তুচ্ছ করতে পারে এতোই ডেসপারেট এসব ছাত্ররা। কিন্তু সরকার তাদের নিউট্রাল বানিয়ে দিয়েছে। টাকাপয়সা, জায়গাজমি, কওমী সনদ দিয়া জামাতের প্রভাব খেকে বাইর করে এনেছে। এটা যতোটা না ভোটের হিসাব তারও বেশী পলিটিক্স। হেফাজত নৌকায় ভোট দিবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে না- এটাই সরকারের একটা বড় পাওয়া।
সরকার উৎখাতের সাম্প্রতিক উস্কানী ও ষড়যন্ত্রে এই শক্তিটাকে খুবই মিস করছে বিএনপি জামাতসহ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। শফী সাহেবের বয়স ও অসুস্থতায় অঘোষিত হেফাজতের দায়িত্ব পান পুত্র আনাস। বাবুনগরী আউট মানে জামাত আউট। তাই ক্ষমতা ফিরে পেতে মরণকামড় দিতে এ আন্দোলন। সাথে পরিপূর্ণ সাপোর্টে শিবিরের ক্যাডাররা। হাটহাজারির ঘটনা মাদ্রাসা বন্ধে থাকবে না, এটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিবে জামাত। এমনিতেই সুতার উপর ঝুলতে থাকা জামাতের অস্তিত্বের প্রশ্ন এটা।
এদিকে ভিপি নুরু আজকে অনেকটাই প্রকাশ্যে জামাত শিবিরের পক্ষে সাফাই গাইলেন। আজকে রাজধানীতে এক মানববন্ধনে তিনি বলেন, “কে শিবির করবে বা করবে না সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যাক্তিগত বিষয়। তার অধিকার আছে যদি সে চায় শিবির করতে সে করবে, এখানে কারো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।”
নাম প্রকাশ না করা শর্তে শফি অনুসারী একজন হেফাজতে নেতা বলেন, “নুরু যে শিবির তা আমরা বহু আগে থেকেই বলে আসছি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে “ছাত্র সংঘ” নাম পালটে “ছাত্র শিবির” নাম ধারন করছে, রগ কাটা আর জঙ্গি অভিযোগে “ছাত্র শিবির” নাম পালটে “ছাত্র অধিকার” নাম ধারন করছে, এটা এখন স্পষ্ট। তা না হলে শিবিরের প্রতি নুরু সাহেবের এত মায়া কেন??”
এদিকে ঘটনার দিন বুধবার থেকে পরদিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পৌরসভা বিএনপির সদস্য সচিব শুক্কুর মেম্বারকে মাদ্রাসার বাহিরের গেইটের সামনে অবস্থান করতে দেখা গেছে। কেন তিনি এখানে কেন অবস্থান করছেন বারবার তা জানতে চাইলে তিনি বরাবরই দৈনিক অপরাজিত বাংলাকে এড়িয়ে যান।
এদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার জনাব জাকারিয়া নোমান ফয়জী মারফত সর্বশেষ অনুষ্ঠিত মজলিশে শুরার সিদ্ধান্ত জানা যায় যে,
>আল্লামা আহমদ শফি সাহেব হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিমের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। শূরা কমিটি তাঁকে সদর মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
>মাওলানা আনাস সাহেবকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং গতকালের সব সিদ্ধান্ত বলবত রেখেছে শূরা কমিটি।
> মাওলানা নুরুল ইসলাম কক্সবাজারিকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এবং সে সাথে, পরবর্তী মুহতামিম নির্ধারণের দায়িত্ব শূরা কমিটিকে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার আনাসকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতিসহ ছয় দফা দাবিতে মাদ্রাসায় বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্ররা। তাঁরা মাদ্রাসার সব কটি ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। আনাস সহ কয়েকজন শিক্ষকের কক্ষে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহীকে মাদ্রাসার ভেতরে পেয়ে মারধর করেন ছাত্ররা। আহত অবস্থায় তিনি এখন নগরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেখানে তাঁরা প্রথম দাবি দেন, আনাসকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতির। অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—আনাস কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়া তিনজন শিক্ষককে পুনর্বহাল করা। আনাস কর্তৃক নিয়োগ করা সব অযোগ্য শিক্ষককে ছাঁটাই করা। ছাত্রদের ওপর জুলুম-হয়রানি বন্ধ করা। আহমদ শফী বয়স্ক হওয়ায় একজন দক্ষ আলেমকে মাদ্রাসার পরিচালক নিয়োগ করা। শুরা কমিটির সদস্য আবদুল কুদ্দুস, নুরুল আমীন, আবুল কাসেম ফেনীসহ বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া।
বর্তমানে পুরো হাটহাজারী থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শুরা কমিটির সিদ্ধান্ত নেবার পরও দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে নিজেদের যার যার বাহিনী শক্তিশালী করার প্রানন্ত চেষ্টা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায় ইতিমধ্যে দু’পক্ষই নাকি বিপুল পরিমান অস্ত্র সস্ত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছে, যদিও এ বিষয়ে তাৎক্ষনিক কোন সত্যতা দৈনিক অপরাজিত বাংলা খুঁজে পায়নি। নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় এক ব্যাক্তি শংকা প্রকাশ করে বলেন যে, ”বিএনপি জামাত সমর্থিত ক্যাডারা সক্রিয় হয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তারা ও শুনতে পেরেছেন যে, চট্টগ্রাম, সাতকানিয়া থেকে অনেক মাদ্রাসা ছাত্র নাকি হাটহাজারীতে জড়ো হচ্ছে। ওদিকে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাদ্রাসা ছাত্ররা হাটহাজারীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বলেও এলাকার অনেকের কাছে খবর আছে।” এবিষয়ে উনার কাছে বস্তুনিষ্ঠ কোন প্রমান আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এসংক্রান্ত কোন কিছু প্রতিবেদেকে জানাতে পারেন নাই।
এদিকে বাবুনগরীর গ্রুপের দাবি ছাত্রদের আন্দোলন সফল হয়েছে।সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন্ধ ঘোষণা অকার্যকর। শনিবার থেকে ক্লাস শুরু হচ্ছে।