ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের সচেতন রাজনৈতিক অঙ্গন। জাতির পিতার ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা করে হেফাজতে ইসলাম সহ কিছু ধর্মীয় সংগঠনের উস্কানীমূলক বক্তব্য সারা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে আঘাত করেছে।
ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশের সাংবিধানিক রূপরেখাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর মতো আস্পর্ধায় পর্যবসিত করার জন্য প্রানপণ চেষ্টা চলছে এসব ধর্মীয় সংগঠন গুলোর মধ্যে।
সম্প্রতি রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে সে কাজ অবিলম্বে বন্ধের দাবি তুলেছেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক।
আর গত ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী বলেছেন, যে কোনো দল ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়া হবে’।
“ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটবে এবং ওই ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলবো”- বলে হেফাজতে ইসলামের নব্য আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর এধরনের ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য ও হুমকি দেশের সচেতন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য প্রদান ও সংবিধান অবমাননার অভিযোগে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার (১লা ডিসেম্বর) দুপুর আড়াইটা থেকে মৎস ভবন থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ঢাকা ক্লাব, শাহবাগ মোড় ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাট পর্যন্ত এই মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে।
উক্ত মানববন্ধনে সরকার সমর্থক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের ৬০টি সংগঠনের অংশগ্রহন থেকে একযোগে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী এবং যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের গ্রেপ্তার দাবি জানানো হয়।
তাদের ওই মন্তব্যের প্রতিবাদে অবিলম্বে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার এবং জামায়াত-হেফাজতের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয় মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে।
কর্মসূচিতে অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক বলেন, “তাদের বক্তব্য (ভাস্কর্যবিরোধী) প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ জবাব দেবে। পরিনাম ভালো হবে না। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেওয়ার পরেও এখনও তাদের নিয়ে কিছু বলা হয়নি। এটাই আপনাদের সৌভাগ্য। দৃষ্টান্তমূলক পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশ নেয়া যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, “এবার যখন আমরা ধরব, ফাইনাল হয়ে যাবে। এবার আর কোনো কম্প্রোমাইজ (আপস) নয়। বাংলাদেশে একটা কুচক্রী মহল সৃষ্টি করে ফায়দা লোটা, এটা বারবার হবে না।”
তিনি ক্ষোভের সাথে আরো বলেন, “চোরের দশ দিন, গেরস্তের এক দিন। আমরা এবার তাদের দেখে নেব।” যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা সজাগ ও সোচ্চার থাকবেন। আমরা এদের দমন করব।”
অন্যদিকে গত রবিবার (২৯শে নভেম্বর) দুপুরে পুরানা পল্টনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, “বেশ কিছুদিন ধরে কিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে মাহফিল করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারদলীয় কিছু সংগঠন আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। আমার রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থানসহ জাতির সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরা জরুরি মনে করছি।”
উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে মামুনুল হক আরও বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান নেতা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুসলিম নেতা হিসেবে পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা করি এবং তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি। কখনো কোনোভাবেই এমন একজন প্রয়াত মরহুম জাতীয় নেতার বিরুদ্ধাচরণ করি না, করা সমীচীনও মনে করি না। আবারও স্পষ্ট করে বলছি, আমাদের বক্তব্য ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়।”
হেফাজত নেতা মামুনুল হক আরও বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ কিংবা প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ অনৈসলামিক সংস্কৃতি হওয়ায় আলেম সমাজ এর প্রতিবাদ করছে। সেই সূত্রে আমিও ভাস্কর্য তথা মূর্তি নির্মাণের বিরুদ্ধাচারণ করে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। কিন্তু সুকৌশলে একটি মহল ভাস্কর্য নির্মাণের এই বিরোধিতাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধিতা বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন।” বক্তব্যের এ পর্যায়ে তিনি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও সৈয়দ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাইয়ের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও বিষোদগারের ব্যাপারে প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীতে সদ্য আসা সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
তিনি বলেছেন, “যদি সাহস থাকে, তাহলে মাঠে আসেন। মাঠে খেলা হবে। আমাদের ভয় দেবেন না। বাংলাদেশের যুবলীগ নামলে এক সেকেন্ডও দাঁড়াইতে পারবেন না। তাই চ্যালেঞ্জ কইরেন না।”
গত সোমবার (৩০শে নভেম্বর) চট্টগ্রামে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বদিউল আলমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে মামুনলকে উদ্দেশ করে একথা বলেন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে যোগ দেওয়া নিক্সন চৌধুরী।
নিক্সন চৌধুরী বলেন, “আমরা দেখতে পেলাম মামুনুল হক, উনি মঞ্চে দাঁড়াইয়া বক্তৃতা দিতে দিতে উইঠ্যা যায়। মনে হয় নাইমা পড়বো। কারে চ্যালেঞ্জ করে? শেখ হাসিনারে চ্যালেঞ্জ করে!
“আরে শেখ হাসিনা তো অনেক উপরের বিষয়। আজকে সারা বাংলাদেশে যুবলীগের সাথে লইড়া দেখেন। আসেন, দ্যাখেন, খেলা হবে।”
তিনি বলেন, “আরে শেখ হাসিনা তো অনেক উপরের বিষয়। আজকে সারা বাংলাদেশে যুবলীগের সাথে লইড়া দেখেন। আসেন, দ্যাখেন, খেলা হবে।”
মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সন আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুর এই যুবলীগ। শেখ ফজলে শামস পরশের যুবলীগের সাথে মোকাবেলা করার এক মিনিট ক্ষমতা আপনার নাই। শেখ পরশ এবং নিখিল ভাইর নেতৃত্বে যুবলীগ যদি মাঠে নামে, ওস্তাদ দৌড়াইয়া কুল পাবেন না। তাই আমার নেত্রীরে চ্যালেঞ্জ করার আগে নেত্রীর সন্তানদের সাথে একটু বুইঝ্যা নেন। তাই এরকম ধমক দিয়েন না।”
বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। ধর্মভীরু মুসলমানদের কিছু ইসলামপন্থী দলের নেতারা তাদের নিজেদের মতানৈক্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে দেশে ধর্মের নামে, ধর্মীয় অনুশাসনের নামে জনগনের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। যা দেশের সার্বভৌমত্ব ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অতি দ্রুত এসব সুযোগ সন্ধ্যানী ও ধর্মকে অপব্যাখ্যা দিয়ে সৃষ্টি করা অরাজকতাকে রুখতে এখনই এসব নামওয়াস্তে ইসলামী সংগঠনগুলোর কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। না হলে অর্থনীতিতে বিশ্বে দ্রুত উদীমান বাংলাদেশ দরিদ্র ও ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হতে বেশী সময় প্রয়োজন হবে না। তারা আরও মনে করেন, সরকার ও প্রশাসন এ বিষয়গুলোকে দ্রুত শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রন না করলে দেশে নতুন কোন সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে, যেখানে অন্যসব উঁৎ পেতে থাকা সুযোগসন্ধ্যানীরা দেশের আভ্যন্তরীন সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।