ঢাকাশনিবার , ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
  1. অনান্য
  2. অপরাধ ও আইন
  3. অভিবাসীদের নির্মম জীবন
  4. অর্থনীতি
  5. আত্মসাৎ
  6. আন্তর্জাতিক
  7. ইতিহাস
  8. উদ্যোক্তা
  9. এশিয়া
  10. কৃষি
  11. ক্যাম্পাস
  12. খেলাধুলা
  13. গণমাধ্যম
  14. গল্প ক‌বিতা
  15. চট্টগ্রাম বিভাগ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

জীবনের অকাজঃ—-

নিজস্ব প্রতিবেদক
সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০ ৪:০১ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

মশিউর  রহমান

মশিউর রহমান

বাড়ীর পাশের নবগঙ্গা মরতে মরতে একটা খালের মত দেখায় এখন।আমার ছোটবেলার নবগঙ্গার কথা মনে পড়লে ডাকছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আরও কাঁদতে ইচ্ছে করে, যখন দেখি ভাটপাড়া থেকে দীঘলিয়া পর্যন্ত পর্যন্ত গ্রামগুলোর বৈচিত্র্যময় বাসীন্দারা হারিয়েগিয়ে একটা সম্প্রদায়ের মানুষেরা শুধু নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত মারামারি কামড়াকামড়ি করছে আল্লাহর মাটির অধীকার নিয়ে। অথচ এখানে আইনের বিচারের ধার কেহ ধারে না। গায়ের জোর তথা বংশের লাঠি কতগুলো আর লাগলে বাইরের কতজন যোগদিবে দলে, সেই হিসেবটা বড় হয়ে দাড়ায়। এমন একটা পরিবেশের মধ্যে আমাদের পৈতৃক বাড়ী।

আগে আমাদের পড়শি ছিলেন সব সনাতনধর্মী। আমার বাপ-চাচারা তাদের সম্পদ যতটা সম্ভব তা’রা চলে যাওয়ার সময় কিনেকুটে রেখেছেন দলিলমূলে। আর নামপত্তন ভোগদখলেও পাকাপোক্ত আছে। ফলে বড়ীটির চারপাশ ফাঁকা খোলামেলা। জোস্না রাতে বাড়ীর ভিতরে কেহ হাটাহাটি করলেও দূরথেকে দেখা যেত। ক’বছর আগে একটি জমিনিয়ে এক মিয়াসাব ঝামেলা পাকাতে চেষ্টা করে দারুনভাবে পর্যদুস্থ হ’লে পাশআলের সবাই এখন শান্ত।
আমরা ছ’টি ভাই আপনচাচাতো মিলে। বোনও আছে চারজন। একটি বোন ছোটবেলায় বাতাসলেগে( আসলে পলিওতে আক্রন্ত হয়ে) পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ওকে বিয়ে দিয়ে বাড়ীতেই রেখে দেওয়া হয়েছে। সেও এখন এক ভাইয়ের সমতুল্য। আমরা পাঁচ ভাই চাকুরী করি,ঐ ভগ্নিপতি আর এক ভাই বাড়ীতে থাকে। জমাজমি ঘরসংসার ওসব ওদের জিম্মায়। বাবা চাচারা একএক করে সবাইকে বিয়সাদী করিয়ে তাদের দায় একরকম শেষ করেছেন আমি আর ৫ম ভাইটি তখনও বিয়ে করিনি। অবশ্য একেবারে ছোটটি এক সাহা মশায়ের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছে মাত্র ১৯ বছর বয়সে। মেয়েটি তখন সবেমাত্র ইন্টারপাশ করেছে। ভাইটি আমার ডিগ্রী’র থার্ডইয়ারে উঠেছে। বাবা আর চাচা কলহ এড়ানোর জন্য গাঁয়ে রটিয়ে দিলেন আমরা কখোনো ওদেরকে মেনে নিব না। দরকার হ’লে ছেলেকে ত্যাজ্য করে দেব। অথচ, ছেলেকে কলেজ বদলিয়ে, গোপন স্থানে বাসা ভাড়া করে বৌসহ রেখেদিয়ে দুজনের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বুদ্ধিমতী মেয়ে স্বামীর সাথে নিজেও লেখাপড়াটা চালিয়ে নিচ্ছে।
আমাদেরই পড়শি এক সনাতনী দাশ পরিবার। ওরাও সাতটি ভাই। ওদের ছ’ন্বর ভাইটি শিবু দাশ। কৃষিজীবী পরিবার। আমাদের দুরবর্তি কয়েক বিঘা জমি ওরা চাষকরে। সেসুবাদে ওদের বড়ীতে আমাদের অবাধ যাতায়ত ছিল। তাছাড়া গাঁয়ের মাঠে, স্কুলেও একসাথে যাতায়ত করেছি ওরা আর আমরা। সে হিসেবে বাল্যসখাও বলা চলে। ওরা কেনজানি ছ-সাত ক্লাসে উঠেই লেখাপড়া ছেড়ে হাল-লাঙ্গলে বা অন্যকোন কাজে লেগে পড়তো। অথচ, আমাদের ভাইদের মাঝে সবথেকে কম শিক্ষিত জনও আই এস সি পাশ। ওকেই সবাই পরামর্শ করে বাড়ীতে রেখেছিলাম।সেও নিজের চেষ্টায় সরকারী প্রাথমিকে শিক্ষকতায় ঢুকেগেল।
এখবর পেয়ে আমি বাড়ীতে এসেছি। বাবা আর চাচা কেন যেন সব বিষয়ে আমার মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেন। বাড়ীতে কথাবলে বুঝলাম এই চাকুরী করতে ভাই ইচ্ছুক।যদিও এখন তাকে দৈনিক ত্রিশ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে স্কুলে আসা যাওয়ায়। আমি সন্মতি দিলাম। চাকুরীটি পেতে কোন টাকা পয়সা খরচা লাগেনি এটাও একটা ভালো দিক।
আপাততঃ একটি বাইসাইকেল কিনতে হবে ওনার যাতায়তের জন্য। বাবা হিসাব দিলেন, মাষ্টারের কাপড়চোপড় সব মিলিয়ে দশ হাজার টাকা দরকার। আমি পাঁচ হাজার দিয়ে বললেম, আর আমি দিতে পারব না। বাকিটা জোগাড় করে নিও। মনে হয় মনোঃক্ষুন্ন হলেন বাবা আর চাচা। আমি বিয়েশাদি করিনি, টাকা কি করি?এ প্রশ্নটি মনেহয় সবার মাথায় ঘোরে।
বিকালে হাটতে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে শিবুদের বাড়ীর দিকে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথেই পালানে শিবুর বৌকে দেখলাম ঘুটে তুলছে বাঁশের ঝুড়িতে। জানতে চাইলাম কেমন আছ রাঙ্গাবৌ?
দাদা রাঙ্গাবৌ না বলে বলেন রাঙ্গাদাসী। বৌটির মুখে একথা শুনে বুঝলাম সে খুব কষ্টে আছে। কেনরে বৌ, তোমাকে রাঙ্গাদাসী কেন বলবো?
দাদা এটা হিন্দুর ঘর। এখানে বিধবার কষ্ট দেখার কেউ নাই। সেই সূর্য্যদয়ের আগে উঠি আর রাতে সবার পরে ঘরে যাই।দুটো পেটের ভাত আর তিনখানা সাদাথানের লোভে সবার দাসী হয়ে আছি। আমার যে যাওয়ার মত কোন যায়গা নেই। এভূবনে আমাকে দেখার যে কেউ নেইগো দাদা। দু’বছর আগে আপনাগো শীবু কলেরায় মারা যাওয়ার পর সেই যে থান পরে ঝাড়ু হাতে নিয়েছি, মরার আগে আর নিস্তার নেই।
পরদিন মরা নবগঙ্গার ঘাটে শিবুর বৌ আমাকে বললে, দাদা আমাকে শহরে কোন একটা কাজে লাগাতে পারেন না আপনি? আমি বাঁচতে চাই দাদা। সারাজীবন এখানে পড়ে থাকলে, এদের দাসীগীরি করেও বুড়ো বয়সে না খেয়েই মরতে হবে। এখন যদি কোন কাজকাম করে নিজে চলতে পারি আর কিছু সঞ্চয় করতে পারি তবে হয়ত শেষকালে না খেয়ে মরতে হবে না। জানো দাদা আমার মা’কে আমার ভাই দেখে না। তিনি ভিক্ষে করে দুটো আনলে সেদিন বৌদী তাকে দুটো খেতে দেয়। নইলে উপোষ থাকেন।
সব শুনলাম, বললাম তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি এবার ঢাকা যেয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করে এসে তোমাকে নিয়ে যা’ব। কথা দিলাম, তবে আমি তোমাকে এখান থেকে সাথে করে নিতে পারব না। বিকল্প কোন ভাবে আমার কাছে তোমাকে পৌঁছাতে হবে। মাথা নেড়ে সায় দিল বৌটি।
বৌটি এস এস সি পাশ করেছিল,ও আমার ঠিকানা চাইলো। আমি ঢাকায় ফিরে আসবার ক’দিন পরেই ওর এস এস সি পাশের যাবতীয় কাগজপত্র আর একটা চিঠি পেলাম ডাকে। ওর জন্ম তারিখ হিসেব করে দেখলাম আঠারো বছর সাতমাস। ডিপার্টমেন্ট এর এক এস পি সাহেবকে সব খুলে বললাম। তিনি রাজি হলেন। সামনে একটি নিয়োগ আছে, বললেন নিয়ে আসিও। যদি মাপে আর মেডিকেলে টিকে তবে যে ভাবে হোক ওকে ভর্তিকরে দিব। নিয়োগের এক সপ্তাহ পূর্বে বাড়ীতে গেলাম, গোপন পরামর্শে রাঙ্গাবৌকে দূরে ওর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে পাঠিয়ে নিয়ে এলাম ঢাকায়। নিয়োগের আগের দিন দেখা করলাম স্যারের সাথে। বললেন, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। ওখানে ডাক্তার নমিতা আছেন, তিনি ওকে চেকআপ করবেন।যেহেতু তুমি বলছ, ও বিধবা। সেহেতু আগেভাগে একটা চেকআপ করিয়ে নেই। যদি কোন অসুবিধে থাকে তবে সেমতে ব্যবস্থা নেব। আমি নমিতাকে সব বলে রেখেছি।
একবছর স্বামীর ঘরকরা বীথিকে দেখে, চেকআপ করে ডাঃ নমিতা আমাকে বললেন, আগামীকাল ওকে লাইনে দাড় করান। আশাকরি হয়ে যাবে। বাদবাকি আল্লাহর ইচ্ছা। বীথি পুলিশ কনেষ্টবলে নিয়োগ পেল। নিজেই সাথে নিয়ে টাঙ্গাইলে ওকে পৌঁছে দিয়ে এলাম। ছমাসের ট্রেনিং ও ভালোভাবেই শেষ করলো। ট্রেনিং শেষে ওর পোষ্টিং হ’লো ঢাকা মেট্রোতে। সমাপনীয় কুচকাওয়াজে আমি যেতে পারিনি, বীথি পোষ্টিং লেটার হাতে নিয়ে আমার অপিসে এসে হাজির। একেবারে গড়হয়ে প্রণাম করলো আমাকে।হাতধরে টেনে তুলে ধমক দিলাম একটা, জানোনা ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় এভাবে প্রণাম করা চলে না। পিছিয়ে গেল তিন কদম, এবার পুলিশের নিয়ম মাফিক এগিয়ে এসে স্যালুট করল।
সাথে করে নিয়ে গেলাম এস পি স্যারের অপিসে। পি এ-কে বলে অনুমতি নিয়ে সালাম জানালাম দুজনে। স্যার খুশি হয়ে দোয়া করলেন।
তারপর কেটেগেছে অনেক বছর। বীথিকে আবার বিয়ে দিয়েছি। চাকুরীতেও উন্নতি করেছে সে। এখন বীথি দুটো ছেলের মা আর একজন এস আই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল অপরাজিতবাংলা ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন oporajitobangla24@yahoo.com ঠিকানায়।