দুর্নীতির শেকড় বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে বিষ বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্ণীতির কড়াল গ্রাসে রাষ্ট্রের একটি শ্রেণী ধনী হচ্ছে যাদের সংখ্যা অনেক কম। অপরদিকে রাষ্ট্রের বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্রতার নিম্ন স্তরে পতিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপি বিভিন্ন দেশে দুর্ণীতির চিত্র, সমাজপতিদের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরার কাজ করে যাচ্ছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নামক আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা। তাদের প্রতিবেদনে উঠে আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশ ভারতের চিত্র।
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দেয়া হয় ভারতে। আর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কম্বোডিয়া। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে ভারতের এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
জানা যায়, দেশটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা পেতে চলে ঘুষের খেলা। কথিত ও সর্ব পরিচিত দৃশ্য ‘টেবিলের নিচে’ মুহূর্তে একহাত থেকে আরেক হাতে চলে যাওয়া নোটের কল্যাণে চাইলেই মিলছে সব এবং বিষয়টি খুবই সাধারন ও নিয়মে পরিনত হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এশিয়ার ১৭টি দেশের ২০ হাজার মানুষকে নিয়ে এক সমীক্ষা চালিয়ে এমন ভয়ঙ্কর চিত্র পেয়েছে সংস্থাটি। জরিপের ফলে দেখা যায়, ভারতের ৬৩ শতাংশ মনে করেন তারা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন তবে তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।
সংস্থাটি তাদের জড়িপ চালাতে গিয়ে দেখে, দেশটির ৩৯ শতাংশ মানুষ তাদের দেশেই সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে তাদের ঘুষ দিতে হয়েছে এবং হয়। এটি এশিয়ার সর্বোচ্চ ঘুষের হার। এই হার নেপালে ১২ শতাংশ, বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ, চীনে ২৮ শতাংশ এবং জাপানে ২ শতাংশ ছিল।
সমীক্ষায় জানা গেছে, গত ১ বছরে ভারতে দুর্ণীতি বেড়েছে বলে দেশটির ৪৭ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন।
তবে দেশটির সরকার দুর্ণীতি বন্ধ করতে আন্তরিক ভাবে ভালো কাজ করছেন বলে মনে করেন দেশটির ৬৩ শতাংশ মানুষ। এতেই বুঝা যায় বর্তমান কট্টর রক্ষনশীল মোদির বিজেপি সরকারের প্রতি দেশের বেশীর ভাগ মানুষেরই আস্থা আছে।
সংস্থাটির সমীক্ষায় আরও দেখা যাচ্ছে, সরকারী পরিষেবা পেতে ৪৬ শতাংশ মানুষকে উপরের মহলের সাথে যোগাযোহ করতে হয়। যাদের মধ্যে ভারতের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্য উপর মহলে যোগাযোগ করেন। এদের মধ্যে ৩২ শতাংশ মনে করেন উঁচু জায়গায় যোগাযোগ না করলে তারা পরিষেবা পেতেন না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জড়িপে মূলতঃ জনগনের সেবামূলক ক্ষেত্রগুলো যেমন, পুলিশ, আদালত, সরকারি হাসপাতাল, পরিচয়পত্র পাওয়ার প্রক্রিয়া এবং বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবা পাওয়ার অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
এর মধ্যে জরিপে উঠে আসে সবচেয়ে বেশী পুলিশকে ম্যানেজ করে পরিষেবা পাওয়ার বিষয়টি। ভারতের পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল কাজেই কোন না কোন ভাবে ঘুষ দিতে হয়।
জড়িপে সর্বোচ্চ ৪২ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাদের পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ৪১ শতাংশ মানুষকে পরিচয়পত্র এবং অন্যান্য সরকারী কাগজপত্র পেতে ঘুষ দিতে হয়েছিল।
এসব ক্ষেত্রে কাজ হাসিল করতে ভারতের বহু সংখ্যক মানুষ তাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগও ব্যবহার করেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
ঘুষ নিয়ে ভোট দেয়ার চিত্রও উঠে এসেছে এই জরিপে। ভারতে এ হার ১৮ শতাংশ, অবস্থান চতুর্থ। ২৮ শতাংশ হার নিয়ে এ ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন।
প্রথমবারের মতো, জরিপে সরকারি কর্মকর্তাদের পরিষেবার দিতে যৌনতা চাওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারতে এর হার ১১ শতাংশ। ১৮ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ায়, শ্রীলঙ্কায় ১৭ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ১৫ শতাংশ।
সংস্থাটির জরিপে জানা যায় যে, ভারতের উচ্চ স্তরের ক্ষমতার কাছে পরবর্তি স্তর গুলো অনেকটাই নির্ভর। দেশটির অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, খুব দ্রুত দুর্ণীতি বন্ধ করা কোন সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে পরিষেবার ক্ষেত্রে সাধারন মানুষ যদি সচেতন না হয় তা হলে এ ধরনের দুর্ণীতি বন্ধ হবার আশু কোন সম্ভবনা নেই।
উল্লেখ্য যে, ভারতের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এই ঘুষ বাণিজ্য। ঘুষের কারণে ঋণের দায়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে দেশটিতে।