চট্টগ্রামের বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাউসার মাহমুদ গত ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত বা গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা গেছেন বলে দাবি করা হলেও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একাধিক সূত্র ছাড়াও জানা গেছে, কাউসার গত ৪ আগস্ট তো নয়ই, এমনকি তার একদিন আগে-পরেও নিউমার্কেট এলাকাতেই যাননি। শয্যাশায়ী ছিলেন নিজের বাসায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১৬ দিন পর হঠাৎ করে তার বাবা চিকিৎসকদের জানান, ভর্তির আগের দিন ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কাউসার ‘শারীরিকভাবে আঘাত’ পেয়েছিলেন। তবে চিকিৎসকরা তার শরীরে আঘাত পাওয়ার কোনো লক্ষণ খুঁজে পাননি। স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, কাউসার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানেরও অন্তত ছয় মাস আগে থেকে জটিল কিডনি রোগের চিকিৎসা নিয়ে আসছিলেন।
৬ আগস্ট কাউসার মাহমুদের সম্পূর্ণ পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের ইমপ্রেশনে উল্লেখ করা হয়, তার ক্রনিক রেনাল প্যারেনকাইমাল ডিজিজ (স্টেজ-৩)। অর্থাৎ তার দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ তখন সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ২১ আগস্ট প্রথমবারের মতো কাউসার ও তার পরিবার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের চিকিৎসকদের জানান, হাসপাতালে ভর্তির আগে ৪ আগস্ট কাউসার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘শারীরিকভাবে আঘাত’ পেয়েছিলেন।
গত ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় কিডনি রোগে আক্রান্ত কাউসারের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে আগ্রাবাদ এলাকার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২২ সেপ্টেম্বর তাকে সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেখানে শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটলে কাউসারকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘২৪ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় আর্মি অ্যাভিয়েশনের হেলিকপ্টারে ঢাকা সিএমএইচে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে স্থানান্তর করা হয়।’ রোববার (১৩ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাউসার মাহমুদ মারা যান। পরদিন তাকে চট্টগ্রাম নগরীর মোগলটুলীতে দাফন করা হয়।
কাউসারের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার মারা যাওয়ার পেছনে দুটি কারণ তুলে ধরা হয়। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, কাউসার পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। কোথাও আবার বলা হয়, তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছিল আন্দোলন চলাকালে। পুলিশের ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে তিনি আহত হন— এমন দাবিও করা হয়।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কাউসার মাহমুদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আহত হন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) কাউসারের ভগ্নিপতি বিল্লাল হোসেনও কাউসারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। পরে অবশ্য এমন দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
কাউসারের ছোট ভাই সুলতান মো. নাইম বলেন, ‘আমার ভাই গত ৪ আগস্ট নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে পেটায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন। মার খেয়ে আহত হয়ে বাসায় ফিরে এলেও সে বাবার ভয়ে বিষয়টি গোপন করে যায়। সন্ধ্যার দিকে সে খারাপ লাগছে বলে বাসার মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যায়। ১৭ দিন পর জ্ঞান ফিরে এলে সে মারধরের ঘটনাটি খুলে বললে তখন আমরা পুরো বিষয়টি জানতে পারি। মারধরের ফলে তার দুটো কিডনি অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়।’
একটি গণমাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এও বলা হয়, ‘৪ আগস্ট দুপুরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র রূপ নেয় নিউমার্কেট এলাকা। এক পর্যায়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন রাস্তায় ফেলে কাউসারের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। একের পর এক কিল, ঘুসি, লাঠি, লোহার রডের আঘাতে রক্তাক্ত করা হয় পুরো শরীর। পেটে লাগাতার লাথি মারতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমন বর্বর হামলায় কাউসারের দুটি কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে লিভারে ইনফেকশন ধরা পড়ে। মাথায় আঘাত পাওয়ায় দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। এসব জটিলতা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটতে থাকেন।’
১৫ অক্টোবর সংবাদমাধ্যমের কাছে তার বাবা আবদুল মোতালেব দাবি করেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কাউসারের কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। এর আগে কাউসারের কোনো অসুখ ছিল না। আইসিইউতে থেকে বের করার পর ১৭ দিনের মাথায় ছেলে আমাকে বলে সে আন্দোলনে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছে। ভয়ে আমাদের বলেনি।’
মোগলটুলীর বাসাতেই ছিলেন ৪ আগস্ট
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট কিংবা তার আগে ও পরে কাউসার চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট বা আশেপাশের এলাকায় গিয়েছেন— এমন কোনো প্রমাণ ও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। অপরাজিত বাংলার নিজস্ব অনুসন্ধান ছাড়াও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি করানোর আগ পর্যন্ত অন্তত কয়েকদিন কাউসার মোগলটুলীতে তার বাসাতেই ছিলেন। কাউসার মাহমুদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরায় হলেও তার পরিবার চট্টগ্রাম নগরীর মোগলটুলী এলাকায় স্থায়ী। কাউসারের কিডনিজনিত অসুস্থতার বিষয়টি এলাকায় প্রায় সবারই জানা আগে থেকে। তার এক প্রতিবেশী জানান, কাউসার প্রায় ছয় মাস ধরে কিডনি রোগের চিকিৎসা নিচ্ছিল। মাসখানেক আগে স্থানীয় মসজিদে কাউসারের বাবা ছেলের জন্য দোয়াও চেয়েছিলেন। এমন অসুস্থ ছেলের পক্ষে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সম্ভবই ছিল না।
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়লেও কাউসার এমইএস কলেজে ছাত্রলীগের ওয়াসিম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা ছাড়াও দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বহু ছবিও রয়েছে তার। ফেসবুকে তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলের বেশিরভাগই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে। তবে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে একটি পোস্ট দেখা গেলেও ২ আগস্ট সেখানে একমাত্র মন্তব্যে তার এক বন্ধুকে দেখা গেছে কাউসারের ‘রোগমুক্তি কামনা’ করতে।
কাউসারের বাবা আবদুল মোতালেবও পাঠানটুলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
আহত হওয়ার খবর প্রকাশ পেলো ১৬ দিন পর
চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১৬ দিন পর ২১ আগস্ট প্রথমবারের মতো কাউসার ও তার পরিবার চিকিৎসকদের জানান, হাসপাতালে ভর্তির আগের দিন ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কাউসার ‘শারীরিকভাবে আঘাত’ পেয়েছিলেন। ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের রেফারেল নোটে এটি নথিভুক্ত করে উল্লেখ করা হয়, ‘রোগীকে ২১ আগস্ট তারিখে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এরপর রোগী হাসপাতালে ভর্তির আগে ৪ আগস্ট শারীরিক নির্যাতনের ঘটনার কথা জানান। এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমসিএইচে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, কিন্তু রোগীর সঙ্গী সিএমসিএইচে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানান।’
ওই রেফারেল নোটে কাউসারের চিকিৎসায় গঠিত বোর্ডের আটজন চিকিৎসকের নাম রয়েছে। এরা হলেন— সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেহেদী হাসান, কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এমএ কাশেম, ডা. মকসুদুর রসুল ও আবদুল কাদের, নিউরোলজিস্ট ডা. সৌমেন চৌধুরী ও ডা. জামান আহমেদ, ভাস্কুলার সার্জন ডা. আহসান মুন্না এবং অর্থোপেডিক সার্জন হোসাইন আহমেদ।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা অপরাজিত বাংলাকে জানান, ‘৫ আগস্ট কাউসার মাহমুদকে ভর্তি করানোর পর তার বাবা বা পরিবারের কেউ তিনি যে কোনো হামলায় আহত বা অন্য কোনোভাবে আঘাত পেয়েছেন এমন কোনো কথাই জানাননি। তাছাড়া তার শরীরের কোথাও আমরা আঘাত পাওয়ার কোনো চিহ্নও দেখতে পাইনি।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রায় ১৬ দিন পর এসে তারা জানান, কাউসার মাহমুদ নামের ওই রোগী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের হামলায় আহত হন। পরে আমরা আমাদের রেফারেল নোটে সেটা উল্লেখও করেছি পরিবারের বরাত দিয়েই।’
হাসপাতাল রিপোর্টে কোথাও নেই আঘাতের কথা
অপরাজিত বাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট কাউসারকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করানোর আগে প্রথম যখন জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তার খিঁচুনি ও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। গায়ে ছিল জ্বর। পরিবারের লোকজন তখন তার ডায়রিয়া হচ্ছিল বলেও জানান কর্তব্যরত চিকিৎসককে। ওই সময়ের তাৎক্ষণিক পরীক্ষায়ও কাউসারের শরীরে আঘাতের কোনো লক্ষণ ছিল না। খিঁচুনি ও তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকায় জরুরি বিভাগ থেকে তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ)। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে কাউসারের ‘এমআরআই’ পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষায়ও আঘাতের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি।
কাউসারের শরীরে ৫ আগস্টে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন— এমন দাবি করে তার বাবা আবদুল মোতালেব অপরাজিত বাংলাকে বলেন, ‘তার পুরো শরীরে দাগ ছিল। মোটা মোটা কালো কালো দাগ।’
কিন্তু ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কাউসারের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, শারীরিক আঘাত কিংবা মাসল ব্রেকডাউনের কোনো লক্ষণ তার মধ্যে ছিল না। ভর্তির পর প্রথম ১৬ দিন তার পরিবারের কাছ থেকেও এমন কোনো তথ্য তারা পাননি। তবে প্রচণ্ড পিটুনিতে ‘মাসল ব্রেকডাউন’ হয়ে কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে— এমন কথা জানিয়ে কাউসারের মেডিকেল-বোর্ডে থাকা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল কাদের বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতেও আঘাতের লক্ষণ শরীরে থাকবেই।’
২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের রেফারেল নোটে উল্লেখ করা হয়, ‘২২ বছর বয়সী মো. কাউসার মাহমুদকে ৫.৮.২০২৪ তারিখে সকাল ১১:০০ টায় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোগীর অভিযোগ ছিল, ৮ থেকে ১০ দিন ধরে মৃদু জ্বর, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১০১°F, ৮-১০ দিন ধরে পাতলা পায়খানা এবং ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ধরে পায়ের দুর্বলতা। রোগীর বাবা জানিয়েছেন, রোগীর ৬ মাস ধরে ক্ষুধামন্দা ও ওজন কমে যাওয়ার ঘটনা এবং কয়েকদিন ধরে পিঠে ব্যথা ছিল। রোগী পিঠের ব্যথার জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এবং ব্যথানাশক ওষুধ খাচ্ছিলেন। ইনটেনসিভিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, ইন্টার্নিস্ট এবং নিউরোলজিস্টের পরামর্শে রোগীকে ইউরেমিক এনসেফালোপ্যাথি, একিউট কিডনি ইনজুরিসহ (একেআই), ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) এবং ক্রিটিকাল কেয়ার নিউরোপ্যাথিসহ চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
কিডনি রোগে ভুগছিলেন, ছিলেন স্টেজ-থ্রিতে
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, কাউসার মাহমুদ গত অন্তত এক বছর ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির অন্তত ছয় মাস আগে থেকে তিনি এর চিকিৎসাও নিয়ে আসছিলেন।
৫ আগস্ট ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তির পর ৭ আগস্ট কাউসারের বন্ধু, সহপাঠী ও স্বজনরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাহায্য চেয়ে যেসব পোস্ট করেছেন, তাতেও কাউসারের কিডনিজনিত অসুস্থতার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। ওইসব পোস্টে দেওয়া গুগল ড্রাইভের লিংকে কাউসারের চিকিৎসার যেসব কাগজপত্র ও রিপোর্ট আপলোড করা হয়, সেখানেও সম্প্রতি ‘আঘাত বা আহত’ হওয়ার কোনো তথ্য বা লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৬ আগস্ট কাউসার মাহমুদের সম্পূর্ণ পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের ইমপ্রেশনে উল্লেখ করা হয়, তার ক্রনিক রেনাল প্যারেনকাইমাল ডিজিজ (স্টেজ-৩)। অর্থাৎ তার দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ তখন সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ওই সময় কার্যত তার দুটি কিডনিই কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
চিকিৎসকরা বলছেন, রেনাল রোগের শুরু হওয়ার পর রোগী কখন স্টেজ-৩-এ পৌঁছাবে তার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। তবে কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে, রেনাল প্যারেনকাইমাল ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ (সিকেডি) প্রথম পর্যায় থেকে স্টেজ-৩ পর্যন্ত পৌঁছাতে গড়ে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে, তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে এটি দ্রুত হতে পারে। কিন্তু দুই বা তিনদিনের ব্যবধানে এমন হওয়া প্রায় অসম্ভব।
হাসপাতালের ভর্তির দিন ৫ আগস্ট কাউসারের বায়োকেমিস্ট্রি রিপোর্টে দেখা গেছে, তার ইউরিয়া সেরামের মাত্রা ২৫৫, যার স্বাভাবিক মাত্রা সর্বোচ্চ ৫০। ক্রিয়েটিনিন-সেরামের মাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৭৪, যার স্বাভাবিক মাত্রা সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৩০। চিকিৎসা-পরিভাষায় এই ধরনের উচ্চমাত্রা কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার সংকেত দেয়।
এমন ‘পরিকল্পনা’ কি সরকারি ঘোষণার পরই?
গত ১৭ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন সরকারি হাসপাতালে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করবে সরকার। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা বিল গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে এবং প্রয়োজনে এসব বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার সকল বিল সরকার বহন করবে মর্মে জানানো হয়।
এর তিন দিন পর ২১ আগস্ট প্রথমবারের মতো কাউসার ও তার পরিবার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের চিকিৎসকদের জানান, হাসপাতালে ভর্তির আগে ৪ আগস্ট কাউসার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘শারীরিকভাবে আঘাত’ পেয়েছিলেন।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও কর্মকর্তা অপরাজিত বাংলাকে জানান, তাদের মনে হয়েছে সরকারি ঘোষণা আসার পর পুরো বিষয়টিই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে মূলত চিকিৎসাসুবিধা পাওয়ার জন্য। হয়তো খারাপ উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।
পাঠানটুলী এলাকায় কাউসারদের প্রতিবেশীদের কেউ কেউ আমাদের সংবাদ প্রতিনিধিকে বলেছেন, চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার জন্য গুরুতর অসুস্থ ছেলেটাকে হয়তো তার বাবা প্রভাবিত করে থাকতে পারেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঠানটুলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতাও ‘মানবিক কারণে’ কাউসারের বাবাকে আন্দোলনে আঘাত পাওয়ার বিষয়টি সামনে আনার পরামর্শ দেন। সেলিম মাহমুদ নামের ওই নেতা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ পেতেও সহায়তা করেছিলেন কাউসারের বাবাকে। তবে পরবর্তীতে সবকিছু দেখেশুনে তিনিও বিস্মিত।
সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘ছেলেটাকে জান্নাত নসিব করুক দোয়া করি, কিন্তু বাবা হয়ে যেভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে। আহারে নাটক। যদি তার সত্যটা উদঘাটন করে প্রকাশ হয় আল্লাহ ভালো জানেন কী অবস্থা হবে? ডিজিএফআইয়ের তদন্তকারী মাঠে আছে। আমার সাথে কথা হয়েছে আজ থেকে দশদিন আগে। আমিও কিছু মিথ্যা বলছিলাম, কারণ এই ছেলেটার যাতে ভালো একটা চিকিৎসা হয়। কিন্তু সে যে এই নাটক করবে কল্পনাও করি নাই। তবে আশা করি সত্য প্রকাশ হবে ইনশাআল্লাহ।’