স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশের মানচিত্রে ২১শে আগস্ট একটি ভয়াবহ নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের দিন। আজ থেকে ১৬ বছর আগে এই দিনে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৎকালীন বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। যে হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিলো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূণ্য করতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। সেদিন শেখ হাসিনা মারাত্মক আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও হত্যা করা হয়েছিলো আওয়ামী লীগের অনেক প্রাণের স্পন্দনকে। তৎকালীন জঙ্গি মৌলবাদী জামাত সমর্থিত বিএনপি সরকার নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ জঘন্য নৃশংসতম গ্রেনেড হামলা করে।
সেদিনের ঘটনার দৃষ্যপটে দেখা যায়, মঞ্চে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আকস্মিক বিষ্ফোরনে মারাত্মক বিশৃংখলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ।
ভাগ্যের জোড়ে সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা কিন্তু এ নৃশংসতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেন নি তৎকালিন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেগম আইভি রহমান। ঢাকা’র তৎকালিন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে এক মানব বলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। ইতিহাসের জঘন্যতম এ হামলায় নিহত হন আরও ২৪ জন। নিহতরা হলেন, আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব:) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা). মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, ইসাহাক মিয়া, এম শামসুদ্দিন এবং মোমেন আলী।
আহত হন ৫’শর ও অধিক নেতা কর্মী। চিরতর পঙ্গু হয়ে যান আহতদের অনেকেই যারা আর স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসেন নি। মেয়র হানিফের মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত অস্ত্রোপাচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্পিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপাচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গ্রেনেডের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাছিনার শ্রবণ শক্তি।
মারাত্মক ভাবে আহত হন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রায়ত আব্দুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত এডভোকেট সাহারা খাতুন, সাঈদ খোকন, মোহাম্মদ হানিফ, এএফএম বাহাউদ্দিন নাসিম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, আওলাদ হোসেন, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, মাহবুবা পারভীন, এডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, মামুন মল্লিক ও নজরুল ইসলাম বাবু প্রমুখ।
জঘন্যতম এতোবড় এই হত্যাকান্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকার নিলিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পাঁচটি গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমান নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় এ হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ঘৃন্য অপচেষ্টা পর্যন্ত করেছেন। বেশ কয়েকটি বিদেশী মিশন যেমন ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, ইউএস ফেডারেল ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ইন্টারপোল বাংলাদেশী তদন্তকারীদের যোগ দিলেও এসব প্রতিষ্ঠানকে বিএনপি সরকার তাদের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছিল।
তৎকালিন বিএনপি সরকারের তদন্ত শুরু হলে বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুরজ্জামান বাবর ঘটনার সাথে তারেক রহমান জড়িত আছেন বলে দাবি করে বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর বড় পুত্র তারেক রহমান এ হামলার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছিলেন।”
এ হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠীর সন্ধানদাতার জন্য সে সময় বাবর এক কোটি টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। হামলার পর স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুরজ্জামান বাবরের তত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ পরবর্তী তদন্তে তাদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুকুল পরিস্থিতিতে সরকার এ হামলার পুনারায় তদন্তের নির্দেশ দিলে এবং সাড়ে তিন বছর পর বিলম্বিত পুলিশ চার্জ শিট নথিভুক্ত করা হয়। অথচ বিএনপি’র কতিপয় সংসদ সদস্য এই জঘন্য হামলাকে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হামলা বলে দাবি করেছিল।
উল্লেখ্য যে, একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়ে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন বিচারিক আদালত। স্মরনাতীতকালের এ ভয়াবহ হামলায় আহত নিহতদের জন্য রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
কর্মসূচি: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে ২১ আগস্ট ২০২০ শুক্রবার সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। উল্লেখ্য, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গ্রেনেড হামলার দিনটি স্মরণে সীমিত পরিসরে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নেতারা, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে উপস্থিত থাকবেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সব স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
দৈনিক অপরাজিত বাংলা