ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের বলা উক্তি ধরে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। সেটি মনঃপুত হয়নি সরকারের। ইউনূসের প্রেস উইং আসে বার্তা। ‘বুঝেশুনে’ সংবাদ প্রকাশ করতে বলা হয়। একই দিন প্রায় সব সংবাদ মাধ্যম মাতাবরাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি ব্যয় টাকা বাড়ানোর খবর চেপে যায়।
পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদেরকে একটি কথা বলেছিলেন। সেটি সংবাদ আকারে প্রকাশ করে দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে হুমকির সুরে আসে বিবৃতি।
হুমকির ভাষাটা পরোক্ষ। এতে লেখা ছিল, “আমরা সকল সংবাদমাধ্যমকে সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের অনুরোধ জানাই।” ঘটনাটি ঘটে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের সভার পর। বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে ব্রিফিংয়ে আসেন উপদেষ্টা। এর মধ্যে একটি ফোন আসে, সেটি কেটে দিয়ে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের এত শিক্ষক… ৩০০-৪০০-৫০০ শিক্ষক সবাই কেন এত ভিসি হতে চায়, আমি বুঝি না।”
এসময় নিজের কথাও তুলে ধরে বলেন, “আমি তো কখনও ভিসি হতে চাইইনি।…শত শত ভিসি হতে চান, প্রো-ভিসি হতে চান, ইনারা পড়াতে চান না কেন। বুঝতে পারছি না আমি।”
এরপর এ বিষয়ে আর কথা বাড়াতে গিয়েও ‘আ… সরি’ বলে পূর্বের আলোচনায় ফিরে আসেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রশাসনের শীর্ষ পদের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দেওয়া হয় অথবা তারা নিজেরাই সরে যান। সেসব পদে পুনর্নিয়োগের কাজ গত দুই মাসেও শেষ হয়নি।
শিক্ষা উপদেষ্টা এর আগেও এসব পদের বিপরীতে তদবির পাওয়ার কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। তবে একনেক বৈঠকের পর ফোন পেয়ে এ বিষয়ে আর কথা বাড়াননি তিনি।
যথারীতি একনেকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে সংবাদ ছাড়াও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদ মাধ্যম।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর প্রথম আলো পত্রিকা সেই সংবাদ তুলে নেয়। শিরোনাম উঠিয়ে একনেকের ব্রিফিংয়ের অন্য একটি প্রসঙ্গ তোলে ধরে তারা। আগের প্রসঙ্গের একটি লাইনও ছিল না তাকে।
কেন সংবাদটি তুলে নেওয়া হল, সেই ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি, আগের সংবাদটি ভুল ছিল, এমন কথাও বলা হয়নি।
এই প্রশ্নের জবাব আসলে পাওয়া যায় কিছুক্ষণ পর, যখন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বার্তা আসে। তাতে লেখা হয়, “গত ৭ অক্টোবর পরিকল্পনা ও অর্থ উপদেষ্টা একনেক সভার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো জানানোর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
শুরুতে তার ব্যস্ততা ও শারীরিক ক্লান্তির কথা বুঝাতে তিনি বলেছিলেন, তার কাছে চারশো থেকে পাঁচশো ভিসি, প্রোভিসি হওয়ার আবেদন আছে যা তিনি এখনো যাচাই-বাছাই শেষ করতে পারেননি।
“এ প্রসঙ্গে তিনি (ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ) মজার ছলে বলেছিলেন, সবাই ক্লাসে পড়ানোর চাইতে এসব পদে যেতেই আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের প্রতি সত্যিকার অর্থে তার এ ধরনের মন্তব্য করার প্রশ্নই ওঠে না।” কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টার বক্তব্যের ভিডিও আছে, সেখানে তিনি মজার ছলে এমন কথা বলেছেন, সেটি অনুমান করার সুযোগ ছিল না, আর এমন কথা তিনি নিজেও বলেননি।
সেই বিবৃতিতে এরপর লেখা হয়, “তার (ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ) হালকাভাবে বলা কথাকে পুরো শিক্ষক সমাজের প্রতি বিরূপ বক্তব্য হিসেবে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সংবাদের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আমরা সকল সংবাদমাধ্যমকে সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশনের অনুরোধ জানাই।”
প্রশ্ন হল, হালকা ছলে বলা কথা নাকি সিরিয়াসলি বলা কথা, সে প্রসঙ্গ সাংবাদিকরা কীভাবে বুঝবেন। আর অফ দ্য রেকর্ড বলে অনেকেই অনেক কিছু বলে থাকেন, সেসব সংবাদ মাধ্যমে আসেও না। কিন্তু ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সে কথাও বলেননি।
আর কথা বলেছেন শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টা নন। তাহলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং কেন বিবৃতি পাঠাল, সেই ব্যাখ্যাও নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি জনসংযোগ বিভাগ আছে, তাদের জনসংযোগ কর্মকর্তা আছে।
ব্যয় বাড়ানোর তথ্য চেপে গেল বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম
এখানেই শেষ নয়, একনেকের সেই বৈঠকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া দুটি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ইউনূস সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরেই বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকার প্রকল্প নিয়ে ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
কিন্তু কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে কলমের এক খোঁচায় ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া এই গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের খরচ সামান্য বাড়িয়ে ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সেখান থেকে প্রায় ৩৭ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়ে এখন ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ইউনূস সরকার। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিন বছর। ২০২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি শেষ করতে চায় তারা।
এখানেই শেষ নয়, ব্যয় বাড়ানো হয়েছে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পেও।
আওয়ামী লীগ সরকার এই প্রকল্পের ব্যয় ঠিক করে রেখেছিল সর্বশেষ ১৮ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। অন্তর্বর্তী সরকার সেখান থেকে বাড়িয়েছে ৩৭৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকায়।
কেন ব্যয় বাড়ল, তার ব্যাখ্যা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দিতে পারেননি। ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ‘টেকনিক্যাল’ এবং তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি ‘অবগত’ নন। কোনো প্রকল্পে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা বা ৩৭ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। কিন্তু এ বিষয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছে হাতে গোনা দুই একটি সংবাদ মাধ্যম। প্রধান প্রধান মিডিয়ার মধ্যে কেবল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
এর কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশ জার্নাল, একুশে টেলিভিশনের অনলাইন এবং এখন টেলিভিশনের মত দুই একটি সংবাদ মাধ্যমে খবরটি আসে। কিন্তু প্রথম আলো শিরোনাম করেছে ‘গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ পাচ্ছে জাপান’, অথচ এটি আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্ত। সেই সংবাদের ভেতরে ব্যয় বাড়ার তথ্যটিও নেই। আর ৫০০ জন ভিসি হতে চান, সেই সংবাদের পুরোটা পাল্টে দিয়ে এই সংবাদটি পরে করা হয়।
ডেইলি স্টারের শিরোনাম করেছে ‘Matarbari Deep-sea Port: Interim govt to continue the Japan-funded project: planning adviser’ অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার জাপানি অর্থায়নের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ এগিয়ে নেবে।
ব্যয় বৃদ্ধির তথ্য এই সংবাদে থাকলেও তা একেবারেই ভেতরে। আর ডেইলি স্টার বাংলায় এই সংবাদটি প্রচারই হয়নি। টিবিএসের শিরোনাম ছিল ‘একনেকে ২৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকায় ৪ প্রকল্প অনুমোদন’। এতেও ব্যয় বৃদ্ধির তথ্যটি ছিল না। সমকালে সংবাদটি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। কালের কণ্ঠ শিরোনাম কমেছে ‘একনেকে ২৪ হাজার ৪১২ কোটি টাকার চার প্রকল্পের অনুমোদন’। এতে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বহীনভাবে তুলে ধরা হয়েছে একেবারে নিচের দিকে।
বণিক বার্তা শিরোনাম করেছে ‘দুর্নীতি কিছুটা কমলেও চাঁদাবাজি কমেনি’। সংবাদের ভেতরে ব্যয়বৃদ্ধি বা প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই নেই। শেষ লাইনে লেখা ছিল, ‘এর আগে একনেক সভায় চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। আর সাতটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।’
এর কয়েক ঘণ্টা পরেই ‘বুঝে শুনে’ সংবাদ প্রকাশ করার ‘অনুরোধ’ করে বিবৃতিটি আসে ইউনূসের দপ্তর থেকে। দেশের প্রধান
সংবাদ মাধ্যমগুলো কীভাবে আগেই বুঝে গেল, সেই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? -এনওয়াই বাংলা স্পেশাল